ইশতেহার মেনে চলার ইশতেহার চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-19 21:36:44

নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলো নানা প্রতিশ্রুতির পসরা নিয়ে হাজির হয়। রাজনীতির ভাষায় একেই ইশতেহার বলা হয়। নির্বাচনের ক’দিন আগে থেকে ইশতেহার নিয়ে খুব আলোচনা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতেহারের ভালো-মন্দ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু ভোটের পরের দিন থেকে ওই ইশতেহার নিয়ে আর কোনো আলোচনা নেই। কাজেই একথা বলাই যায়, ইশতেহারের মেয়াদ ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত। ইশতেহার নিয়ে এতো যে আলোচনা, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ভোটাররা ইশতেহার গবেষণা করে ভোট দেয় না। আমাদের রাজনীতিতে ইশতেহার এখনও ভোটার বা নাগরিকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। মার্কিন মুলুকে ইশতেহার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক হয়। আমাদের দেশেও হয়। কিন্তু উভয় দেশের আলোচনায় একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে এই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ থাকে কতিপয় কলামবিদ ও টকশো তারকাদের মাঝে। কিন্তু আমেরিকায় ইশতেহার প্রদানকারী দল ও নেতাকে নিজ নিজ ইশতেহারের পক্ষে সাফাই গাইতে হয়। গণমাধ্যমে ও সভা-সমাবেশে বিতর্কের মাধ্যমে ইশতেহারের যৌক্তিকতা জাহির করতে হয়। আর আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা ইশতেহার দিয়েই লাপাত্তা। বিতর্ক ও সেই ইশতেহারের পক্ষে কথা বলার জন্য একদল সুশীল ও বিশ্লেষক সব দলেরই আছে। নেতা-নেতৃদের কিছু না করলেও চলে। তবে, হয়তো এভাবে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়েই আমাদের দেশেও নির্বাচনী ইশতেহার সত্যি একদিন গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে।

ভোটে ইশতেহারের গুরুত্ব থাকুক আর নাই থাকুক, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাভাবনার অন্তত একটা ফিরিস্তি পাওয়া যায়। ইশতেহারে সব দলই ভালো ভালো কথা বলে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও রাজনৈতিকদলগুলোর অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো জানা যায়।

বিএনপির ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করার কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা  অনেক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কোন কোন ক্ষমতা সীমিত করা হবে বা না হবে সেটি জানা জরুরি। কিন্তু এটাও ঠিক যে ইশতেহারেতো সব বিষয় বিস্তারিত বলা হয় না। এই এজেন্ডাটি যখন বাস্তবায়ন হবে তখনই তা যাচাই-বাছাই করে ঠিক করা হবে। তবে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীসভা সবাই সংবিধানের অধীন। একমাত্র সংবিধানই সার্বভোম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে সংবিধান, সংসদ, রাষ্ট্রপতি সবই প্রধানমন্ত্রীর অধীন। কারণ, মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মতো কাজ করতে হয়।  কাজেই, গণতন্ত্রের জন্যই ক্ষমতা একটা ভারসাম্য প্রয়োজন।

ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। সবচেয়ে বড় কথা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যেও ক্ষমতার একটি ভারসাম্য থাকা চাই। সেটি করতে হলে সংসদকে কার্যকর করতে হবে।  কার্যকর সংসদ ও কার্যকর বিরোধী দলই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। সংসদের উপকমিটিগুলোকে কার্কর করাও সংসদকে কার্যকর করার একটি উপায়।  সংসদ শুধু হ্যা-না ভোট দেয়া আর ওয়াক আউট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনোদিনই সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারবে না।

ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারে তিনটি বিভাগকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইন বিভাগ বা সংসদ। সংসদ যদি কার্যকর থাকে ও এখানে ক্ষমতার একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পায় তবে তা রাষ্ট্রের অন্য বিভাগগুলোকে কার্যকর করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা সব দলই বলে। ইশতেহারে এসব নিয়ে বড় বড় প্রতিশ্রুতি থাকে এবং ক্ষমতায় এসেই বলে আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি। সব দলই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি করে। কিন্তু নিম্ম আদালতকে এখনও সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনা যায়নি। এ জন্য শুধু সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন করলেই হবে না, বিদ্যমান বাস্তবতায় সরকারের ওপর বিচার বিভাগের নির্ভরশীলতার জায়গাগুলোতে হাত দিতে হবে।মাসদার হোসেন মামলার পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। 

আমাদের বিদ্যমান রাজনীতির একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সরকার পরিবর্তন হলে আগের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বিগত সরকারের মুন্ডুপাত। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতি আমাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। এতে গণতন্ত্রও হয় না, টেকসই উন্নয়নও আসে না। কাজেই, ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে এজাতীয় নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে সে মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও আমরা দেখি ঠিকই সেই পুরনো প্রতিশোধের আগুন। এসব থেকে ফিরে আসার সময় হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অঙ্গীকার করেছে তারা প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করবে। তারা আগের সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। যদিও সবাই তাদের ইশতেহারে এসব বলে থাকে কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। সিপিবিও তার ইশতেহারে ‘রুটিরুজি অধিকারের জন্য শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার’ অঙ্গীকার করেছে।

উন্নত দেশগুলোতে ইশতেহারের ওপর জয়-পরাজয় অনেকটা নির্ভর করে। সেসব দেশে ইশতেহার অনুযায়ীই সরকারগুলো কাজ করে। ইশতেহারের শতভাগ না হলেও ৭০-৮০ ভাগ প্রতিশ্রুতি তারা বাস্তবায়ন করে থাকে। আমাদের দেশ ইশতেহার একদিকে আর বাস্তবায়ন তার উল্টোপথে। কথায় আছে, প্রমিজেস আর মেড টু বি ব্রকেন। ওয়াদা ভঙ্গ করার জন্যেই ওয়াদা করা হয়।আমাদের রাজনৈতিক ইশতেহারও অনেকটা সেরকম। কিন্তু আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো যেসব ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি বয়ান করেছেন ক্ষমতায় গিয়ে যেনো সেগুলো পালনে ব্রতি হন। আর যারা বিরোধী দলে থাকবে তারাও যেনো নিজ দলের ইশতেহারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ না করেন। কারণ, ইশতেহার শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার সনদ নয়। এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা। সরকারে গেলে ইশতেহার বাস্তবায়ন সহজ। বিরোধী দলে থাকলে তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু কোনো দল যদি ইশতেহারে বলে সন্ত্রাসকে তারা প্রশ্রয় দেবে না কিন্তু বিরোধে দলে গেলে যদি নিজেই সন্ত্রাস করে তবে বুঝতে হবে প্রতিশ্রুতিতে গলদ আছে। ইশতেহার বাস্তবায়নের প্র্রশ্নটি আমরা শুধু ক্ষমতাসীন দলকেই করি, কিন্তু বিরোধী দল তার দেয়া ইশতেহারের কী কী বরখেলাপ করেছে বা বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছে সেই চ্যালেঞ্জটি আমরা কখনো করি না। কাজেই সব দল তাদের ইশতেহার মেনে চলবে এটাই কাম্য।

২০০১ সালে বিএনপি যে ইশতেহার দিয়েছিল ক্ষমতায় এসে তা বাস্তবায়নতো করেই নি বরং দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছিল সে সময়ে। রাষ্ট্রের সর্বত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। দুর্বৃত্তায়নের এক মহাযজ্ঞ সাধিত হয়েছে সে সময়ে। ফলে  ‘দিনবদলের সনদ’ নামক এক যুগান্তকারী নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ইশিতেহারে তারা  ঘুষ-দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণের বাইরে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সেসব অঙ্গীকারে কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা আজ এক প্রশ্ন। এভাবে নানা সময়ে দলগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার পুরোটা না হলেও উল্লেখযোগ্য অংশের বাস্তবায়ন হলেও দেশে সুশাসন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের এক অনন্য মাত্রা যোগ হতো। আমরা পেতাম এক অন্য বাংলাদেশ।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর