মাদকে বিপথগামী শিক্ষার্থী ও পথশিশুরা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-08-25 04:07:10

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, রাজধানীর ৮৫ শতাংশ পথশিশু কোনো না কোনো  ধরনের মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। আরেক পরিসংখ্যানে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজধানীতে মাদক সেবীদের ২২৯টি স্পট রয়েছে। সেই তথ্য মোতাবেক জানা যায়, রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, চাঁনখারপুল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট প্রাঙ্গন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বর, কমলাপুর রেল স্টেশন, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থানে অবাধে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ঘুমের ওষুধসহ নানা ধরনের মাদক গ্রহন করছে পথশিশুরা। উল্লেখ্য, বর্ণিত স্থানের হেরফের হতে পারে; কিংবা সংখ্যাও।

সম্প্রতি খবরের কাগজের আরেক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ’(আইসিডিডিআরবি) ও বেসরকারি সংস্থা ‘মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডোলেসেন্ট’(এমএআরএ)-এর তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের মোট পথশিশুর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। তন্মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ৩ লাখেরও বেশি পথশিশু। যার অধিকাংশই মাদকাসক্ত। এদের প্রায় ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। ৩৫ শতাংশ পথশিশু পিকেটিং এবং বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, যদিও হালে পিকেটিং ও বোমাবাজদের তৎপরতা নেই, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওরা তৎপর হতে পারে। আসলে কথাটা এভাবে নয়; বলা উচিত ওদেরকে ব্যবহার করতে পারে কেউ কেউ।

যার জন্য আগাম সাবধানতার প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। যাই হোক, বাকি ২১ শতাংশ পথশিশু ছিনতাই ও আন্ডারগ্রাউন্ডের সন্ত্রাসীদের সোর্স হিসেবে কাজ করছে এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। জড়িত হচ্ছে ছিঁচকে চুরিসহ নানান কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও।

সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুরা মাদকাসক্ত হওয়ার মূল কারণ অবিভাবকত্বহীনতা। এ ছাড়াও দারিদ্রতার অজুহাতে পথশিশুদেরকে নামতে হয় উপার্জনের পথে। উপার্জনের হাতেখড়ি হয় পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ এবং বোতল বা প্লাস্টিক সামগ্রী সংগ্রহের মাধ্যমে। ফেলে দেয়া নানা সামগ্রী কুড়াতে গিয়ে এরা প্রথমে নেশার রাজ্যে পা রাখে। দেখা যায় ভাঙ্গারি দ্রব্যাদি কুড়াতে গিয়ে সাক্ষাত মিলে কোনো মাদকসেবীর সঙ্গে। ওরা মাদক গ্রহণের পর অবশিষ্ট অংশটুকু বাড়িয়ে দেয় শিশুটির দিকে। আবার অনেক মাদক ব্যবসায়ীরা আছে এদেরকে খুঁজে বের করে একটু-আধটু নেশাজাতীয় সামগ্রী হাতে ধরিয়ে দেয়, শিখিয়ে দেয় ব্যবহার পদ্ধতিও। ব্যস্  উৎসুক শিশুদের শুরু হয়ে গেল নেশার রাজ্যে পদচারণা। নেশায় তাড়িত হয়ে শিশুরা তখন মাদক ব্যবসায়ীর কথায় ওঠবস করতে আরম্ভ করে। এ সুযোগে ওদের ময়লা-আবর্জনার ব্যাগে নেশাজাতীয় দ্রবাদি ঢুকিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হুকুম করে। হুকুম তামিল করতে করতে একদিন পথশিশুরা হয়ে ওঠে তুখোড় নেশারু। যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ খোলা থাকে না ওদের।

সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুদের পরেই রাজধানীতে মাদকাসক্ত হচ্ছে বেশি ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা। বাবার অগাধ অর্থ-কড়ি নাশের মোক্ষমস্থান হিসেবে বেছে নেয় এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসকে। অন্যান্য স্থানের তুলনায় ক্যম্পাস থাকে খানিকটা নিরাপদ। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা খুব একটা বিরক্ত করার সুযোগ পায় না ক্যাম্পাসে। ফলে ওরা বেপরোয়া হয়ে নেশায় আসক্ত হচ্ছে খুব সহজে। তৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদেও। হালে যদিও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে জঙ্গিবাদে জড়ানোর সুযোগ তেমন একটা হচ্ছে না, তবে মাদকে জড়িয়ে পড়ছে অবাধে।

বলতে দ্বিধা নেই, ইংলিশ মিড়িয়ামের শিক্ষার্থী মাদকসেবীরা ‘মডার্ণ স্টুডেন্ট’হিসেবে নিজকে পরিচিত করতে পারলে যেন গর্ববোধ করে। নেশাজাতীয় দ্রবাদির সঙ্গে জড়িত হতে না পারলে বন্ধুদের কাছে যেন ওদের মান-ই থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে ভালো শিক্ষার্থীদেরকেও ভিড়তে হয় নেশারুদের দলে। শুধু ছাত্রই নয় ছাত্রীরাও সমানতালে এগিয়ে আছে নেশার জগতে। এদের বেশির ভাগই ইয়াবাসেবীর দলভূক্ত। কেউ কেউ গাঁজা, হেরোইনসহ নানান জাতীয় নেশার চর্চাও করে। সেসব নেশা সামগ্রীর রয়েছে আবার আজব আজব নাম।

ইংলিশ মিডিয়ামের চিত্রটি তুলে ধরার পেছনে আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। নেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ও। এ নিবন্ধন লেখার মূল উদ্দেশ্যটি হচ্ছে অবিভাবকদেরকে সচেতন করা।

অবিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতে হচ্ছে, আপনারা দয়া করে এসব পরিহার করবেন। সন্তানের প্রতি নজরদারি বাড়াবেন। ওদের সব আবদারে সাড়া না দিয়ে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিবেন। তাতে বোধকরি উভয়ের কল্যাণ বয়ে আসবে। একটু সচেষ্ট হলেই বিষয়টাকে আয়ত্তে নিতে পারেন আপনারা। শুধু প্রয়োজন খানিকটা আন্তরিকতার। আমাদের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। মাদকদ্রব্য নির্মূলে সচেষ্টও। জঙ্গি দমনে সরকার যেমন সফল হয়েছেন, তেমনি মাদক নির্মূলেও দৃষ্টান্ত রাখছেন। দৃষ্টান্ত রাখবেন পথশিশুদেরকে মাদকের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করেও। কারণ আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি আজকে মাদকে আসক্ত সে শিশুটি কিন্তু দেশের সম্পদ নয়; বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই বিষয়টা মাথায় নিয়ে পথশিশুদের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। মাদকমুক্ত পরিবেশের আওতায় এনে ওদেরকে গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে যাতে সরকারের প্রচেষ্টা শতভাগ সফল হয়।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর