ক্ষমায় মিলবে ক্ষমতা?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-29 05:44:48

বিরোধী দলের জন্য নির্বাচনী ইশতেহার দেয়া খুব সহজ। ক্ষমতায় গেলে 'এটা করবো, সেটা করবো' বলে দেয়া যায়। কতটুকু পারবো না পারবো, সেটা পরে দেখা যাবে। যারা আগে ক্ষমতায় ছিল, তাদের জন্য কাজটা একটু কম সহজ। কারণ তারা 'এটা করবো, সেটা করবো' বললে, লোকজন মুখের ওপর বলে বসতে পারে, আগে করেননি কেন? যেমন বিএনপি।

আর যারা কখনোই ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পায়নি, তাদের জন্য ইশতেহার দেয়া সবচেয়ে সহজ। সম্ভব-অসম্ভব সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়া যায়। যেমন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে ইশতেহার ঘোষণা সবচেয়ে কঠিন ক্ষমতাসীন দলের জন্য। কারণ তারা যে প্রতিশ্রুতিই দিক, এতদিন কেন করেননি; সেই প্রশ্ন উঠবে। যেমন আওয়ামী লীগ।

তবে আওয়ামী লীগ সেই কঠিন কাজটি দারুণ দক্ষতায় সহজ করে নিয়েছে। এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে যে কয়টি রাজনৈতিক দল ইশতেহার ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গোছানো, পরিকল্পিত, দূরদর্শী আওয়ামী লীগেরটি। ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানও ছিল স্মার্ট ও গোছানো। অনুষ্ঠানস্থলেই ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ ইশতেহার এবং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার উপস্খাপিত ১৬ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ বিলি করা হয়। তবে অনুষ্ঠান কত স্মার্ট ছিল, ইশতেহার কতটা গোছানো তা দিয়ে তো আর এর ভালোত্ব-মন্দত্ব যাচাই করা সম্ভব নয়। ভেতরে কী আছে, সেটাই বিবেচ্য।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল 'দিনবদলের সনদ', ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল 'এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ'। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের স্লোগান 'সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ'। অনুমিতভাবেই আওয়ামী লীগের ইশতেহারজুড়ে ছিল উন্নয়নের বয়ান। এবং সত্যি কথা হলো, এই বয়ানে কোনো মিথ্যা নেই, অতিরঞ্জন নেই।

গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। সকল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে সবাইকে চমকে দিয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ সব খাতে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র কমেছে। বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বেই উন্নয়নের চমক। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ছিল এইসব উন্নয়নের বিবরণ। সাথে আগামীতে এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়। এই প্রত্যয় অস্বাভাবিক লাগে না। কারণ গত ১০ বছরে তারা তা করে দেখিয়েছে। এখন শুধু তা এগিয়ে নেয়া বা নতুন ধাপে উন্নীত করার আকাঙ্খা। দারিদ্র বিমোচনে নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে, তবে বৈষম্যওও বেড়েছে প্রকটভাবে। এ ব্যাপারে আরো নজর দেয়া জরুরি।

তবে গত ১০ বছরে, বিশেষ করে গত ৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা যেসব অভিযোগ এনেছেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, থাকলেও খুবই দায়সারা। গত ৫ বছরে গণতান্ত্রিক স্পেস প্রায় ছিলই না। বিরোধী দলগুলো নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারেনি। মামলা, হামলা, গ্রেপ্তারে বিপর্যস্ত ছিল বিরোধী নেতাকর্মীরা।

দাবি করা হয়েছে, গত ১০ বছরে সংসদই ছিল সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এই দাবি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় দশম সংসদ ছিল অনেকটা হাস্যকর। একই সঙ্গে বিরোধী দল এবং সরকারি দল হওয়ার নজির বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বেই বিরল। আর টানা বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করার শুরুটা আওয়ামী লীগই করেছিল। পরে বিএনপিও সেটা অনুসরণ করে বর্জনকেই সংসদীয় রীতি বানিয়ে ফেলে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'বিরোধী দলকে আমি সংখ্যা দিয়ে গুনবো না।' তিনি বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার মনোনয়নের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি।

শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রায় ছিলই না। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে এস কে সিনহার অস্বাভাবিক বিদায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে। আইনের শাসন, সুশাসনের ঘাটতি ছিল দৃষ্টিকটু রকমের। উন্নয়ন আমরা চাই, তবে গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই কার্যকর গণতন্ত্র।

তবে আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সবচেয়ে বড় ঘাটতি ছিল মানবাধিকারহীনতা। ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর গুমের অভিযোগ ছিল শাসনামলজুড়েই। এবারের ইশতেহারে সার্বজনীন মানবাধিকার সুরক্ষার অঙ্গীকার থাকলেও তা যথেষ্ট শক্ত মনে হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও অনেক সমালোচনা ছিল। বিশেষ করে শেষ সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের শঙ্কিত করেছে। এই শঙ্কা দূর করার কোনো অঙ্গীকার মেলেনি ইশতেহারে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার থাকলেও গত ১০ বছরে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে ব্যাংক খাত এবং শেয়ারবাজারে নানা কেলেঙ্কারি সরকারের অনেক অর্জনকেই ম্লান করেছে।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আরো সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণের অঙ্গীকার করেছেন শেখ হাসিনা। তার কণ্ঠে এ অঙ্গীকার বাগাড়ম্বর মনে হয়নি। কারণ অর্জনযোগ্য নয়, তেমন কোনো স্বপ্ন দেখাননি তিনি। আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭এর ওপরে তুলেছে। বিএনপি যেখানে প্রবৃদ্ধির হার ১১তে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য সেখানে ১০।

শেখ হাসিনা যখন ইশতেহার ঘোষণা করছিলেন, তখন হোটেল সোনারগাওয়ের বলরুমে ছিল মুহুর্মুহু করতালি। তবে সবচেয়ে দীর্ঘ ও স্বতস্ফুর্ত করতালি ছিল, যখন শেখ হাসিনা বলছিলেন, 'মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গিয়ে আমার বা আমার সহকর্মীদেরও ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। আমি নিজের এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমতাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি'; তখন।

তার মানে হলরুমে উপস্থিত আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খীরাও জানতেন তাদের সরকার ভুল করেছে। ভুলগুলো না করলেই ভালো হতো। তবে কাজ করতে গেলেই ভুল হয়। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। তবে বাংলাদেশে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। এ জন্য শেখ হাসিনা ধন্যবাদ পাবেন।

মাঠ একতরফা থাকায় আওয়ামী লীগের এমপি, মাঠের নেতাকর্মীরা গত ৫ বছরে বেপরোয়া ছিল। জনগণ রীতিমত অতিষ্ঠ। তাই এই ক্ষমা চাওয়া জনগণের সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারবে কিনা দেখা যাক। ক্ষমায় মিলবে কি ক্ষমতা?

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর