রাজনৈতিক সঙ্কট: বাস্তবতার উপলব্ধি যত দ্রুত হবে, সমাধান তত দ্রুততর হবে

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-10-10 12:26:27

 

তীব্রবেগে চলছে রাজনৈতিক বাদানুবাদ ও হুঙ্কার। রাজনীতির মাঠে-ময়দানে পারস্পরিক আক্রমণে ব্যস্ত নেতৃবৃন্দ। নেতাদের কথা-বার্তা লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। মোদ্দা কথায়, নিজ নিজ অবস্থানে এখন পর্যন্ত অনড় উভয় পক্ষ। এমনই অচলাবস্থাকে সঙ্গী করে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ।

বাস্তব পরিস্থিতিতে কেউই যখন বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ, তখন সঙ্কট মোচনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে। এর ফলে সবার মধ্যে প্রশ্ন একটাই: এই অচল-পরিস্থিতির শেষ কোথায়? অথচ বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বার্থে এবং আরও ব্যাপকার্থে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও শান্তি-বান্ধব পরিবেশের জন্য অচল-পরিস্থিতির অবসান অবশ্যম্ভাবী।

অনেকেই মনে করছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশ এক অনিবার্য উত্তেজনা ও সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে। আমজনতা, গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি এবং দেশী-বিদেশী নানা মহল এমনটিই আঁচ করছেন। তথাপি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমাধানের প্রশ্নে কাছাকাছি আসার দৃশ্যমান কোনও আলামত নেই। যদিও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই, তবুও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সংলাপের লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না।

এমতাবস্থায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ মিশন বাংলাদেশের নানা পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। আগের মতোই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নিজ নিজ অবস্থানেই অনড়। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নড়েনি একচুলও।

আওয়ামী লীগ মনে করছে বিএনপি সমাধানের সুযোগ রাখেনি। বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং সংসদের বিলুপ্তি চায়। সংবিধানের বাইরে গিয়ে এসব করা সম্ভব নয়। এসব দাবি তুলে বিএনপিই সমঝোতার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বিএনপি জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অবস্থা তুলে ধরে দলটি বলেছে, এবারও একই কায়দায় তারা একতরফা নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। দলীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে হয়রানি, গ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা ও প্রহসনের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে, যা আগামীতে আরও অনেক গুণ বাড়বে। জাতীয় পার্টি মনে করছে, বিএনপি বর্জন করলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার আলোচনা করতে সরকারের সম্মতি প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ রাজি না থাকলে আলোচনা সফল হবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আলোচনা বা সংলাপই যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সমাধানসূত্র আসবে কেমন করে? কারণ, সঙ্কট নিরসনে সংলাপ একটি স্বীকৃত পন্থা। সংলাপের মাধ্যমেই বহু সমস্যার সমাধান বিশ্বের বহু দেশে হয়েছে। এই সংলাপই যদি হতে না পারে বা হওয়ার মতো পরিবেশ না থাকে, তাহলে গায়েবি পদ্ধতিতে আপসেআপ সমাধানের সূত্র এসে হাজির হবে না। আর সমাধান না হলে সংঘাত যে অবধারিত, তা প্রায়-নিশ্চিত।

এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক ‘সঙ্কট’ অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি সংঘাতের আশঙ্কাও অব্যাহত রয়েছে। সামনের নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই সঙ্কটের রূপ-চরিত্র আরও তীব্র এবং ঘণীভূত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের রাজনীতি এগিয়ে চলেছে এক বিস্ফোরক-ভবিষ্যতের দিকে।

বাংলাদেশের বিরাজমান নানামুখী সমস্যার মধ্যে দ্রব্যমূল্য, বাজার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেবাখাত রয়েছে অসহনীয় অবস্থায়। করোনা চাপা-পড়লেও তেজি ঘোড়ার মতো বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। সামনে রয়েছে স্কুল-কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা, যাতে মোটের উপর বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এবং এমনই নানামুখী চ্যালেঞ্জের সঙ্গী হয়ে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান না হয়ে গণতন্ত্রের উৎসব নামে পরিচিত আগামী নির্বাচন যদি উত্তেজনা আর সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সৃষ্টি হবে গভীর বিপদজনক পরিস্থিতির। সামাজিক, অ্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা যুক্ত হয়ে যে ত্রিশঙ্কু বিপদ ডেকে আনবে, নিশ্চয়ই সেটা কারও জন্যেই মঙ্গলকর হবে না। এই অগ্নিগর্ভ বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সকল পক্ষকেই সমঝোতামূলক-সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাক্য-যুদ্ধ বা অনড় অবস্থানে থেকে সামনের সম্ভাব্য পরিস্থিতির ভয়াবহতা মোটেও সামাল দেওয়া যাবে না, এই রূঢ় সত্য উপলব্ধি করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বাস্তবতার উপলব্ধি যত দ্রুত হবে, সমাধানও ততই দ্রুততর হবে। 

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর