রিজার্ভ বাড়ানোর রাস্তাগুলো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে: করণীয় কী?

, যুক্তিতর্ক

মো. মাজেদুল হক | 2023-10-12 13:44:30

আজ থেকে ৫২ বছর আগে বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রাতারাতি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। তখন সারা বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গভীর ছিল না। ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর পরিমাণ ছিল অতি নগণ্য।

রফতানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা সহজ কাজ ছিল না। ১৯৭৬ সালে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে লোক পাঠানো হয়। তখন থেকে প্রবাহ হতে থাকে রেমিট্যান্স। রফতানি আয় বাড়তে থেকে। যেহেতু বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর অর্থনীতি, আমদানি দায় মেটানোর জন্য প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। আর বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস হলো প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়।  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে এই দুই উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা অনেক সহায়ক।

উল্লেখ্য, রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে এবং সৌভাগ্যবান। কোভিড-১৯ সৃষ্ট মহামারির সময় তথা ২০২১-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশি প্রবাসীরা রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল। তখন রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। রিজার্ভের আকার বেড়েছিল। ২০২১ এর আগস্ট মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বলা প্রয়োজন যে, একটা দেশের অর্থনীতি কতটা মজবুত এবং শক্তিশালী তা প্রকাশ পায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আকার দেখে। অর্থাৎ রিজার্ভ হলো যে কোন অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বৈদেশিক ঋণ মঞ্জুর হওয়ার ক্ষেত্রে রিজার্ভ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের কারোর অজানা নেই। বাংলাদেশ হলো আমদানি নির্ভর অর্থনীতি। রফতানি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ আমদানি দায় পরিশোধ করতে হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় যেটা ডলারে আসে তা যুক্ত হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

এছাড়াও বৈদেশিক ঋণ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া গেলে রিজার্ভে যুক্ত হয়। বাংলাদেশ যে রফতানি আয় করে তা দিয়ে আমদানি দায় মেটানো সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যোগ করে আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়। যেটা মূলত রিজার্ভ থেকে করা হয়। বলা হয়ে থাকে ৩ মাসের আমদানি দায় মেটানোর রিজার্ভ থাকলে চলে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশের জন্য কি এটা প্রযোজ্য? এ বছরের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভ রেকর্ড করা হয় ২৩ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ দুই বছরের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন থেকে নেমে ২৩ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে এসেছে। এ বিষয় নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চায়। প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ বা আকার নিয়ে কেন্দ্রিয় ব্যাংক সরকারকে ভুল বার্তা দিয়েছিল। এর খেসারত এখন সরকারকে দিতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার মজুতকে কোনভাবেই মেনে নেয়নি। আইএমএফ এর দৃষ্টিতে রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি সঠিক ছিল না। তখন রিজার্ভের হিসাব করা হতো বিপিএম৫ পদ্ধতিতে। কর্তাব্যক্তিরা রিজার্ভেও আকার দেখে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলো যে সঠিক ছিল না তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। রিজার্ভ থেকে ‘বাংলাদেশ বিমানকে’ বিমান ক্রয়ের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছিল। পায়রা বন্দরের বামনাবাদ চ্যানেল খনন কাজের জন্য ও অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলংকাকেও ঋণ দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়াও, ১৯৮৯ সালে সৃষ্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এ ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে দেওয়া হয়। রফতানিকারকরা যাতে কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি ক্রয় করে দ্রুত পণ্য উৎপাদন করে রফতানি করতে পারে সেই কারণে ইডিএফ থেকে ডলারে ঋণ দেওয়া হয়। এই ডলার নেওয়া হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা যখন বিভিন্ন সেক্টরে ঋণ প্রদান করা শুরু করল, তখন সরকারকে সতর্ক করার জন্য আমি এক বাংলা পত্রিকায় কলাম লিখেছিলাম। আমার কলামের শিরোনাম ছিল ‘বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা’। ওই কলামে রিজার্ভ নিয়ে আমি যে প্রাকল্লন করেছিলাম তা এখন সত্য হয়ে গেছে । আমি ওই কলামে বলেছিলাম যে, বিচার বিবেচনা করে রিজার্ভ ব্যবহার করতে হবে এবং রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়াকে আমি নিরুৎসাহিত করেছিলাম।

সবচেয়ে বড় ভুল ছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে রিজার্ভের আকার সরকারকে বলা হয়েছিল তা ছিল গ্রস রিজার্ভ। যেটার জন আইএমএফ বার বার প্রশ্ন তুলেছিল। আইএমএফ এর উপদেশ তখন বাংলাদেশ ব্যাংক পাত্তা দেই নাই। পরবর্তীতে আইএমএফ যখন বাংলাদেশের অনুরোধে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ম্ঞ্জুর করল তখন শর্ত দিল রিজার্ভ হিসাব করতে হবে বিপিএম৬ অনুযায়ী। অবশেষে ঋণ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ এর নির্দেশনা মেনে নিল অনেক দেরিতে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার আগে রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি বাস্তবায়ন করল বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএমএফ এর শর্তানুযায়ী এ বছরের জুনে নিট রিজার্ভ দেখানোর কথা ছিল ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ২৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। সম্ভবত এটা দেখাতেও ব্যর্থ হবো। এখন রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। আমেরিকার ঋণমান সংস্থা ‘ফিচ’ বলেছে, এই বছরের প্রথম নয় মাসে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতাদের চরিত্র বহুল সমালচিত। 

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ঋণ প্রদান করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যাংক ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি ঋণ। আইএমএফ এর মতে খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি। এদেশের ঋণগ্রহীতাদের চরিত্র এবং বর্তমানে খেলাপি ঋণ এর আকার জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে ইডিএফকে সহায়তা করল? হ্যাঁ, রফতানিকে ত্বরানিত করার জন্য সরকার সহায়তা করেছে। ভালো কথা। কিন্তু ইডিএফ থেকে দেওয়া অধিকাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।

পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, রফতানিকারকরা এই ডলার বিদেশে পাচার করেছে। ২০১৫ সালে ইডিএফ এর আকার ছিল ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে এই আকার বাড়িয়ে করা হয় ৫ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর ২০২১ তথ্য অনুযায়ী, ইডিএফ এর বিপরীতে ফোর্সড লোনের পরিমাণ রুপালী ব্যাংকে দাঁড়ায় ৬০ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকে ৩৩১ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকে ৪১৬ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের উপওে যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়েছে ইডিএফ থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে আর রিজার্ভ থেকে ঋণ পাবে না। এটাই কি সমাধান? ডলার সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য সরকার কিছু আমদানি পণ্যের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। কোনভাবেই ডলার সংকট কাটছে না। এর ফলে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। রফতানি পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না কাঁচামালের অভাবে। আমদানি নিরুৎসাহিত করেও ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের চিত্র দেখা গেছিল শ্রীলংকায়।

রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডলারে পাওয়া এসব ঋণ দিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। কারণ, ঋণ পাওয়া যাবে কিস্তি আকারে। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ৬০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। ইদানিং ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ ছাড় কমে গেছে। এছাড়াও, বিশ্ববাজারে সুদের হার বাড়ায় এবং মোডিস ও এসএ্যান্ডপি কর্তৃক দেশের ঋণমান কমানোর ফলে বেসরকারি খাতও বেশি হারে বিদেশি ঋণ পাচ্ছে না।

বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ এবং আসল মিলে চলতি অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে ৩২৯ কোটি ডলার। আগস্ট মাসে প্রবাসীদেও পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। যে হারে মানুষ বিদেশ (কাজের উদ্দেশ্যে) যাচ্ছে, সে হারে রেমিট্যান্স আসছে না। কার্ব মার্কেটে ডলার রেট বেশি পাওয়ায় প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ৫৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার । এ পর্যন্ত ফিরেছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসী আয় ২১ বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে।

এ পরিস্থিতে বলা যায় যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতি শীঘ্রই বাড়বে না। নির্বাচনের বছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। বাংলাদেশের রফতানি আয় একটি পণ্যের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রফতানি বাজার থেকে বেশি আয় আসবে না। শুল্ক সুবিধা থাকবে না। অভিবাসীদের জন্য নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারি নাই। যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ১৫ থেকে ২০ মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার জন্য রিজার্ভ রাখে সেখানে বাংলাদেশের এর মত স্বল্পোন্নত দেশ কিভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে ঋণ বিতরণ করে? এই মুহূর্তে রিজার্ভ বাড়াতে না পারলে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি থেকে ছিটকে পড়বে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর