রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ও আরব-ইহুদি যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-10-12 15:36:11

 

রাজনীতি ব্যর্থ হলে সংঘাত ও যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সমঝোতা ও সংলাপের পথে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চেষ্টা করে রাজনীতি। কিন্তু সেই রাজনীতি যদি সঠিক পথে চলতে এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন সংঘাত বা যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

এজন্যই বলা হয়, যেখানে রাজনীতি শেষ হয় বা রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে আত্মসমর্পন করে, সেখান থেকেই সংঘাত বা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যে সেটাই ঘটেছে আরব-ইহুদি যুদ্ধের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল সম্ভবত এ কারণেই বলেছিলেন, “যুদ্ধই শেষ অবলম্বনের রাজনীতি হওয়া উচিত। এবং যখন আমরা যুদ্ধে যাই, তখন আমাদের একটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত যা আমাদের জনগণ বোঝে এবং সমর্থন করে।” (War should be the politics of last resort. And when we go to war, we should have a purpose that our people understand and support.) ইহুদি-ইসরায়েল এবং আরব-ফিলিস্তিনিরা এখন তেমনই এক যুদ্ধযজ্ঞে উন্মত্ত।

দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্র আরব অধিবাসীদের ক্ষোভ ও অভিযোগ নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা শক্তির সমর্থনে আরবভূমিতে ইহুদিদের অনুপ্রবেশ ও দখলদারিত্বের কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্য একাধিক বার যুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ইহুদি রাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবকে স্থানীয় মানুষ ও প্রতিবেশীদেশগুলো মেনে নেয় নেয় নি। তারপরও ইসরায়েল চরম নৃসংশতার আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিদিনই আরব ভূমি দখল করছে। একদিকে পশ্চিম তীর এবং অন্যদিকে গাজা এলাকায় অব্যাহত ইহুদি দধলদারির কারণে লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্ত ও ভূমিহীন হয়েছে।

খোদ ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এসব সঙ্কটের সমাধানে সঠিক রাজনীতি করতে পারেনি। ধামাচাপা দিয়ে শান্তি ও সমঝোতার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ থাকলেও দখলদারিত্বের শিকার আরব-ফিলিস্তিনিদের ভূমি, আত্মমর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি দেয় নি। নিজ দেশেই আরবগণ রয়েছে পরবাসী ও পরাধীন। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থায়ী শান্তির দেখা পাওয়া যায় নি এবং সংঘাত ও যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হয় নি।

সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহে চলতি অক্টোবর মাসের প্রথমাংশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। বিধ্বস্ত ও আক্রান্ত হয়েছে ইসরায়েল। প্রতিপক্ষ ‘হামাস’-এর আকস্মিক আক্রমণে ও ভয়ঙ্কর হামলায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে দেশটিকে বিরাট মানসিক ধাক্কাও দিয়েছে। সামরিক দিক থেকে অগ্রসর ইসরায়েল নিজেদের নিরাপত্তা ও শক্তিমত্তা সম্পর্কে যে অতিউচ্চ ধারণা লালন করতো, তা ধুলিস্ম্যাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের অতি-চৌকশ গোয়েন্দা বাহিনীও যে আগাম-তথ্যের বিষয়ে 'বেখবর' ও ‘অপ্রস্তুত’, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক সমঝোতার বদলে শক্তি প্রয়োগ ও হামলা যে আরও শক্তি প্রয়োগ ও পাল্টা-হামলার কারণ ঘটে, সেটাও জানতে পারলো ইসরায়েল।

কিন্তু এসব শিক্ষাকে গ্রহণ না করে ইসরায়েল শক্তির পথেই অগ্রসর হচ্ছে। ‘হামাস’ ও ‘হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে গাজা এলাকাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে অকাতরে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। ইসরায়েল স্থল, জল ও বিমান পথে গাজা এবং আরব-ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে চরম আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সামরিক শক্তি ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে অংশ নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ইত্যাদি ইসরায়েল-পন্থী দেশগুলোর বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশগুলোর মেরুকরণ ঘটছে।

ঘটনার পর পরই ইসরায়েল ব্যাপক সামরিক সেনার সমাবেশ ঘটিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে এবং দেশটির উগ্রবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, দেশে যুদ্ধ বেধেছে। অথচ গত ৭৫ বছর ধরে আরব-ফিলিস্তিনীয়দের উপরে ইসরায়েলি দমন গোটা বিশ্ব ভাল চোখে দেখছে না। ইসরায়েলের নিজেও বোধোদয় হয় নি যে, যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগ সঙ্কটের সমাধান নয়।

ইসরায়েল নিজেও রয়েছে নানা রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে। তাদের গুপ্তচর বিভাগ ও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। ব্যর্থতার ভার বহুলাংশেই নেতানিয়াহু সরকারের উপরে আরোপ করছে দেশটির মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি। এমনকি, সম্প্রতি দেশের বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছিল সে দেশের সরকার, যার কারণে জনগণের নজিরবিহীন বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয় তাদের।

মনে করা হচ্ছে, সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতে নেতানিয়াহু আবার একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করবেন। এতে মধ্যপ্রাচ্যে আপাত যে শান্তি সূচিত হয়েছিল, তা নস্যাৎ হতে পারে। আরব দেশগুলো ও ইসরায়েলের কাছাকাছি আসার প্রক্রিয়াও এর ফলে ব্যাহত হবে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কারণ, চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতি ও অর্থব্যবস্থাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে পরাশক্তিগুলোর মেরুকরণ আরও তীব্র হবে এবং তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়বে। আর তেল সরবরাহ এবং অন্যবিধ সমস্যাও সৃষ্টি হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও নাজুক করবে।

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বহুমাত্রিক বিপদে পড়বে বিশ্বের সাধারণ মানুষ এবং গরীব দেশগুলো। ফলে যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিবেকবান বিশ্ববাসীর সরব হওয়া কর্তব্য। এবং যুদ্ধ ও শক্তির পথ ছেড়ে রাজনৈতিক আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতার পথে যেতে বিবদমান পক্ষগুলোকে চাপ দেওয়াও জরুরি।মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমেই এ সঙ্কটের সমাধান হতে পারে। নচেৎ বিপদের মাত্রা হ্রাসের আশা বিলীন হয়ে যাবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর