পূজার পর আন্দোলন!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-10-14 21:30:11

'ঈদের পর আন্দোলন' বাক্য শুনতে অভ্যস্ত আমরা। বহুল উচ্চারিত এই বাক্যটি তুমুল হাস্যরসের উপাদান হয়ে আছে। সরকারের এই মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সামনে কোন ঈদ নাই বলে কথাটি আর শুনতে হচ্ছে না, তবে এবার কোন ধর্মীয় উৎসবের না উল্লেখ না করে পূজার পর পরই আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

ঈদের পর আন্দোলন; রাজনৈতিক হাস্যরসের বাক্য হলেও 'পূজার পর আন্দোলন' বাক্যটি জোরালোভাবে আসেনি, তবে এই মুহূর্তে এছাড়া আর করণীয়ই বা কী বিএনপির? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে এক দফার আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। এনিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে দলটি। সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিও যুক্ত হয়েছে এই আন্দোলনে। কিন্তু আইনের দোহাই দিয়ে সরকার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি গ্রাহ্য করেনি। আইনি যে সীমাবদ্ধতার কথা সামনে এসেছে যেখানে সেখানে বিএনপিও পারছে না কিছু করতে।

খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর চিকিৎসার জন্যে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ইতোমধ্যেই বিদেশে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ক্ষেত্রে বিদেশে চিকিৎসার আইনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয় সে ব্যাখ্যার বিপরীতে বিএনপি না পেরেছে পৃথক ব্যাখ্যা দিতে, না পেরেছে তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে আইন সংশোধনের পথে নিয়ে যেতে। দলের চেয়ারপারসনকে নিয়ে যে ব্যর্থতা বিএনপির, তার প্রভাবও পড়েছে এক দফা দাবি আদায়েও।

আদালতের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ পড়েছে সংবিধান থেকে। আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরতে চাইছে না। বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে। সরকার দল এবং সরকারবিরোধী অংশগুলোর এই যে অবস্থান সেখান থেকে উত্তরণে একটাই পথ—দুপক্ষের কোন একটা পক্ষকে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যাবে না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এবং আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের সবাই একবাক্যে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকা যে ভিসানীতি দিয়েছে সেখানেও নাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধি দলগুলোর বাংলাদেশে যে সফর হয়েছে সে সব জায়গায়ও নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনা। ফলে বলা যায়, একমাত্র সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া এই ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের মধ্যে আদতে কোন চাপ নেই।

গতকাল শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের এক শান্তি সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার মরিয়া (মরে) ভূত হইয়া গেছে। এগুলো মাথা থেকে নামান। নয়তো এ ভূতে বিএনপি শেষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চিরনিদ্রায় আছে। এ তত্ত্বাবধায়ক আর কোন দিন চোখ খুলবে না।...ফখরুল তত্ত্বাবধায়ক বলতে বলতে শেষ। দুই সেলফিতে আপনাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ভারতে এক সেলফি, এরপর নিউ ইয়র্কে আরেক সেলফি। দুই সেলফিতে বিএনপির ঘুম হারাম হয়ে গেছে।’’

ভিসানীতিতে কেন্দ্র করে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যে দৌড়ঝাঁপ, সেখানেও নাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনা। অথচ বিএনপির যে এক দফা সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায়, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ আছে সত্য, কিন্তু সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্যে নয়। এমন অবস্থায় কী করবে বিএনপি? অথবা কী করতে পারবে আসলে দলটি?

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছিল। ওই দুই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক আলোচনা আছে। সমালোচনাও আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত, তবু সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে, এবং সেখানে বিএনপি অংশও নিয়েছিল। বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহ ফল বিপর্যয় ঘটেছিল সেই নির্বাচনে। ‘দিনের ভোট রাতে হয়ে গিয়েছিল’ বলে যে অভিযোগ করা হয় নানা মহল থেকে, তা সত্ত্বেও সরকারের কিছুই হয়নি। অর্থাৎ সরকার সবকিছু সামলে নিয়ে পুরো পাঁচ বছর দেশ শাসন করে যাচ্ছে। চার বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন কিংবা সুযোগসুবিধা ভোগ করে গত বছর বিএনপির সাতজন এমপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাদের সে পদত্যাগে রাজনীতিতে কোন প্রভাব পড়েনি। সরকার নিয়মমাফিক এবং নির্বিঘ্নে শূন্য হওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচন করেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন সেটা কতদূর গড়ায় সেটা দেখা অপেক্ষার শেষ সময়ে আমরা এখন। কারণ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ইঙ্গিত অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। অর্থাৎ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র আড়াই মাসের কিছু বেশি সময়। জানুয়ারিতে নির্বাচন হলে নভেম্বরের দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা ইসির। ইসির বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। নির্বাচন আয়োজনের জন্যে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ যা কিছু করার দরকার সে কাজগুলো শুরু করে দিয়েছে তারা। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে তফসিল ঘোষণার।

সরকার দল আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশনসহ সবাই যখন চলমান ব্যবস্থায় নির্বাচন আয়োজনের পথে রয়েছে তখনো বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে। দাবি আদায়ে আন্দোলনের কথা বলছে। তারা মাঠে নানা কর্মসূচি পালন করছে ঠিক, কিন্তু সেগুলো এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম, টকশোর বিষয়বস্তু হিসেবে রয়ে গেছে।

নভেম্বরে যদি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়, তবে বিএনপির সামনে খুব বেশি সময় নেই। এদিকে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত এই পূজার আয়োজন রয়েছে। দুর্গাপূজার মধ্যে বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর সম্ভাবনা নাই। এমনিতেই দলটির প্রান্তিক পর্যায়ের বেশিরভাগের মধ্যেই প্রবল সাম্প্রদায়িকতা-সৃষ্ট ধর্মীয় সংকীর্ণতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া, পূজার মধ্যে যদি দেশের কোথাও কোন প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কোথাও কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু যদি হয়রানির শিকার হন, তবে এর দায় গিয়ে পড়বে তাদের ওপরই। ফলে এই সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে পারবে না বিএনপি।

বিএনপি বলছে না যদিও 'পূজার পর আন্দোলন', তবে সেটাই করতে হচ্ছে তাদের। তার কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের নেতৃত্বে জোট ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যে’র কনভেনশনে তিনি সরকারকে দুর্গাপূজার ছুটির মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। মির্জা ফখরুল বলেছেন, “এখনো বলছি, সময় আছে। আমাদের মান্না সাহেব (মাহমুদুর রহমান মান্না) বলেছেন, দুর্গাপূজার কথা।... ভালো কথা। দুর্গাপূজার সময় যে ছুটি থাকবে এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে দেন। লেঠা চুকে যাবে। মানুষ ভোট দিতে যাবে, আপনার তো আর প্রয়োজন নেই।”

নির্বাচনের আর বেশি বাকি নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এখনো অপূর্ণ বিএনপির। পূজার পর পরই তাদেরকে তাদেরকে চূড়ান্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। 'পূজার পর আন্দোলন' ইঙ্গিতটি কি শেষ পর্যন্ত 'ঈদের পর আন্দোলন'-রূপ হয়ে যাবে; কে জানে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর