গাজার হাসপাতালে মৃত্যু মিছিলের পর ওয়াশিংটনকে কে বিশ্বাস করবে?

, যুক্তিতর্ক

সুমন ভট্টাচার্য | 2023-10-20 11:45:36

গাজা হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু শুধু বিশ্বকে বিভাজিত করল না, আমাদের আবার আমেরিকার ভিয়েতনাম কিংবা ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহ ভুল নীতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল। গোটা আরব দুনিয়া তো বটেই, মুসলিম বিশ্বও মনে করছে আমেরিকা বা পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে আসলে মুসলিমদের প্রাণের কোনও মূল্য নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েল সফর এই ক্ষতকে আরও দীর্ঘতর করবে, এবং ইতিমধ্যেই প্রায় সব মুসলিম দেশের রাষ্ট্র নেতারা তাঁর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক বাতিল করে দিয়েছেন।

গাজায় হাসপাতালে হামলা এবং ৫০০ জনের মৃত্যুর পর আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলোর আর রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে কিছু বলার বা মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করার নৈতিক অধিকার থাকল না। এত দিন আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের অন্য দেশগুলো রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দুষেছেন যুদ্ধে ‘সিভিলিয়ান টার্গেট’কে নিশানা করার জন্য। এবং প্রায়শই পশ্চিমের দেশগুলো যারা তাদের জোট সঙ্গী নয়, সেই রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়াকে অমানবিক বা নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু ইসরায়েলের বিষয়ে তারা চুপ করে থাকে। ইসরায়েল বছরের পর বছর গাজা কিংবা ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’কে পৃথিবীর বৃহত্তম খোলা আকাশের নীচে থাকা কারাগারে পরিবর্তন করেছে, ওয়াশিংটন কিংবা লন্ডনের তখনও হুঁশ ফেরেনি। কিন্তু এবার গাজার আল হালিল হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ৫০০ জনের মৃত্যুর পর আমেরিকার মানবাধিকার কিংবা মুক্ত মনের চিন্তা কী হবে?

এরপরেও পৃথিবীর যে যে প্রান্তে যারা আমেরিকার কাছ থেকে কোনও সমানাধিকার, মানবাধিকার, ন্যায্যবিচার বা সমতা প্রত্যাশা করবে তারা হয় উন্মাদ কিংবা মূর্খ। ইসরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে ঘটে চলা যুদ্ধ আবার প্রমাণ করে দিয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো আসলে ‘জিওনিস্ট’ আদর্শকেই সমর্থন করে। তাই ইসরায়েলের যাবতীয় অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং প্যালেস্তিনীয়দের জীবনকে নরক করে দেওয়ার ঘটনাকে দেখেও দেখে না। কিন্তু গাজার হাসপাতালে হামলার ঘটনার পর গোটা মুসলিম বিশ্বই আমেরিকাকে প্রশ্ন করতে পারে, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’।

গাজার হাসপাতালে শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পশ্চিম এশিয়া সফরকে শুধু ব্যর্থই করে দিল তা নয়, একই সঙ্গে আবার আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলোকে ‘উই অ্যান্ড দ্য আদার’-এ তত্ত্বের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল। এই ‘আদার’রা অবশ্যই মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং গোটা মুসলিম বিশ্বই মনে করছে আমেরিকা বা ইউরোপের কাছে একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর প্রাণের কোনও দাম নেই। আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলো ইসরায়েলের সমর্থক এবং মদতদাতা ছিল, আছে এবং থাকবে। সেই কারণেই ইরাকে আগ্রাসন চালানোর সময় আমেরিকা রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে মুসলিমদের ‘শত্রু’ বা এনিমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে ভুল করেছিল, প্রায় ২০ বছরের ব্যবধানে ২০২৩-এ ওয়াশিংটন আবার সেই বিপ্রতীপ অবস্থানে নিজেদের নিয়ে চলে গিয়েছে।

প্রায় ৬০ বছর আগে আমেরিকা এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ, ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর কী অত্যাচার চালিয়েছিল, তা ইতিহাসে লেখা রয়েছে। কিন্তু গত ৬০ বছর ধরে মেকং কিংবা হাডসন দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। গোটা বিশ্বেই মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ, ধর্ম-বর্ণ, গায়ের রঙ নির্বিশেষে মানুষের জন্য সমানাধিকার ইত্যাদি শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এবং খাস মার্কিন মুলুকেও এই শব্দগুলো নিয়ে চর্চা এবং আলোচনা হয়। অনেক মার্কিনিই ভিয়েতনামে তাঁদের করা যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভিয়েতনামে গিয়ে সেখানকার ওয়ার মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছেন। কিন্তু, ইসরায়েল নিয়ে কি আসলে ওয়াশিংটন তার কোনও নীতি বদলেছে? অসলো চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল এবং প্যালেস্তাইন দুটি রাষ্ট্র গঠন, তাদের সার্বভৌম অস্তিত্ব রক্ষা এবং স্বীকৃতির যে কথা হয়েছিল, তা আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলো কি ভুলে গিয়েছে? প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার এবং রাষ্ট্র হিসেবে বিকাশের প্রশ্নটিকে পশ্চিমের এই দেশগুলো কীভাবেই বা উপেক্ষা করে? নাকি আমাদের ধরে নিতে হবে আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে ইরাক আক্রমনের সময় ওয়াশিংটন যা যা ভুল করেছিল, এখনও সেই একই পথে হেঁটে চলেছে? মুসলিম বিশ্বের যেটা অভিযোগ, আসলে আমেরিকা বা ইউরোপ লক্ষ লক্ষ মুসলিম মারা গেলেও ভ্রূক্ষেপ করে না, শুধুমাত্র তারা নিজেদের স্বার্থই বিবেচনা করে?

এবারে প্যালেস্তাইন-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গোটা আরব বিশ্ব এই প্রশ্নই বারবার তুলেছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বাহারিন বা কাতারের মতো যে দেশগুলো আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষর করেছিল, সেইসব দেশের আমজনতাও প্রশ্ন করছিল, প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের বা প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার রক্ষার কী হবে? কিন্তু গাজার হাসপাতালে মৃত্যুর মিছিল পুরো পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের কোনও দেশই আর ইসরায়েলকে বিশ্বাস করতে রাজি নয় এবং তেল আভিভের মদতদাতা হিসেবে আমেরিকাকেও ‘শত্রু’ মনে করতে শুরু করেছে। ইরানের কথা বাদ দেওয়া যাক, তাদের ওয়াশিংয়টন বিরোধী অবস্থান প্রায় চার দশকের পুরোনো। কিন্তু আরব দুনিয়ার অন্য দেশগুলোতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলিম দেশগুলোকে, এমনকি আমাদের প্রতিবেশীও বাংলা দেশেও প্যালেস্তাইনের সমর্থনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে।

রাজনৈতিকভাবে, বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঠিক যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করছেন, ঠিক তখনই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে বেইজিং গিয়ে পৌঁছেছেন। ওয়াশিংটনের একেবারে বিপরীতে গিয়ে মস্কো এবং বেইজিং যে অক্ষ বা ‘অ্যাক্সিস’ তৈরি করেছে। ইতিমধ্যেই তেহেরান সেখানে যোগ দিয়েছে। রাশিয়া, চিন এবং তেহেরানের এই জোটে এবার যদি আমেরিকাকে শত্রু মনে করতে থাকা মুসলিম বিশ্বের বাকি দেশগুলোও যোগ দেয়, তাহলে কী হবে? বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে কী ধরনের অস্থিরতা বা টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে? এখনও পর্যন্ত তা সত্যিই বোঝার উপায় নেই।

কিন্তু একথা অস্বীকার করে কোনও লাভে নেই, গাজার হাসপাতালে মৃত্যুর মিছিল বিশ্ব রাজনীতিকে আবার এক সন্ধিক্ষণের মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। মুসলিম মন এবং হৃদয় যে আঘাতে জর্জরিত, তাতে কীভাবে ক্ষতের প্রলেপ লাগানো হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কি আদৌ এই দগদগে ক্ষতে কোনও প্রলেপ লাগবে? নাকি বিশ্ব আরও বিভাজিত হয়ে যাবে? সেই বিভাজনের অঙ্গ হিসেবেই কি এবার লেবাননের দিক থেকে হিজবুল্লার সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হবে? আরও কতটা রক্ত ঝরার পর আমরা শান্তির মুখ দেখব?

লেখক কলকাতার প্রখ্যাত সাংবাদিক। বার্তা২৪.কম'র নিয়মিত লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর