আমেরিকা-জুজুতে আটকা যখন ইসরায়েলি ‘গণহত্যার’ বিরোধিতা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-10-21 12:36:34

 

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যে কয়টি দেশ তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু, ফিলিস্তিনও একই। বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি নিয়ে যত বিভক্তিই থাকুক না কেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রশ্নে একাত্ম হওয়া নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।

সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং এর জের ধরে গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গণহত্যা বন্ধের আহবান জানিয়েছে। সরকারের তরফে প্রকাশ্য বিবৃতি এসেছে, ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ নিন্দা জানিয়েছে ইসরায়েলি আগ্রাসনের। আজ দেশে রাষ্ট্রীয় শোকও পালিত হচ্ছে।

গত বুধবার সৌদি আরবের জেদ্দায় ওআইসির সদর দপ্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আমরা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাই। গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের বর্বরোচিত বোমা হামলা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। বেসামরিক লোকদের লক্ষ্য করে গাজায় ইসরায়েলের এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ যুদ্ধ মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের সমস্ত মৌলিক নীতির লঙ্ঘন করেছে। তাই আমরা সকল পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গাজায় জরুরি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাই।’ তিনি বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে হামলার কারণে মানবিক পরিস্থিতি সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের মাতৃভূমি থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার জন্য ইসরায়েলের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করি, যা সমগ্র অঞ্চলে মানবিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে।’ সৌদি আরব ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই জরুরি বৈঠক ডেকেছিল।

ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের ভালোবাসা কেবল বক্তৃতা-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গতকাল শুক্রবার সারাদেশের মসজিদ, মন্দির ও অন্য উপাসনালয়গুলোতে প্রার্থনাও হয়েছে। শনিবার বাংলাদেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। গত গত ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে রাশিয়ার প্রস্তাবিত রেজুলেশন পাস না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি অবিলম্বে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের আবেদনও জানান।

বৈশ্বিক সম্মেলনে জোর অবস্থান ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সরকারের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমরা সবসময় ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিলাম, আছি। আমরা কোনো যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই। এই যুদ্ধের ভয়াবহতায় আমরা নিজেরা জীবন দিয়ে দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকে ইসরায়েল যেভাবে প্যালেস্টাইনের জনগণের ওপর হামলা করছে, বিশেষ করে হাসপাতালে হামলা করে যেভাবে নারী শিশু মানুষ হত্যা করেছে, যেভাবে শিশু হত্যা করা হলো, ওই রক্তাক্ত বাচ্চার চেহারা দেখে সহ্য করা যায় না। আমরা এটার নিন্দা জানিয়েছি। আমরা দ্রুত এই যুদ্ধ বন্ধ চাই। যুদ্ধ বন্ধ করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য জায়গা তারা যেন ফেরত পায়। প্যালেস্টাইনে যে জায়গাগুলো ইসরায়েল দখল করেছে সে জায়গাগুলো ফেরত দিতে হবে।’ সরকারের এই অবস্থান ও বক্তব্য পুরো দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনের কথারই প্রতিফলন। বাংলাদেশ যেভাবে মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে থাকার ঐতিহ্য ধারণ করে এটা তারই প্রকাশ।

 

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এই সংঘাত নতুন নয়। আজীবন নিপীড়নের শিকার ভূখণ্ড ফিলিস্তিন। নিপীড়িতের প্রতি সমর্থন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বলেই কিনা বাংলাদেশ বারবার ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ায়। পশ্চিমা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলে। বাংলাদেশের এই ধারাবাহিকতা এখনো অটুট, বিশেষ করে সরকার ও জনগণের। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এবারও সরকারের ঋজু অবস্থান ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের পক্ষে।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি নিপীড়নের প্রধান সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। একপেশে মানবতা তাদের কেবলই ইসরায়েলিদের জন্যে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি তারা এবার দিচ্ছে সামরিক সহায়তা। গাজার হাসপাতালগুলোতে হামলা চালানোর পরেও, হাসপাতালে ওষুধ-জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি সত্ত্বেও তারা মানবিক চোখে দেখেনি মানবতা। অগণন প্রাণের অপচয় হচ্ছে গাজায়, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ; তবু তারা নির্বিকার। তবু তারা ইসরায়েলিদের পক্ষে। তাদের এই পক্ষাবলম্বনে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির জন্যে দেওয়া রাশিয়ার প্রস্তাব পাশ হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র যখন ইসরায়েলিদের পক্ষে, তখন এর প্রভাব দেখছি আমরা বাংলাদেশেও। উপাসনালয়গুলোতে প্রার্থনা এবং রাষ্ট্রীয় শোকের সরকারি নির্দেশনা আসার পর দেশের স্থানে-স্থানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। সাধারণ মানুষদের অংশগ্রহণে এই সব কর্মসূচিতে যদিও ছিল ধর্মের যোগ, তবে শেষ পর্যন্ত এটা মানবিক কর্মসূচিই। তবু এখানে নাই দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি, ধর্মভিত্তিক ও বাম দলগুলো। তারা নেই, কেন নেই?

না থাকার কারণ মূলত রাজনৈতিক, এবং বলা যায় ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাওয়া হবে—এই জুজু! এই জুজু তবে নির্বাচন ও ভিসানীতিকেন্দ্রিক? অথচ ক্ষমতা-আরোহনপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অবস্থান এখানে ধারণ করা উচিত ছিল বিএনপির। বিএনপি প্রকাশ্যে কোন অবস্থান নিচ্ছে না, যদিও ছোট্ট কথায় তারা ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সহমর্মিতা জানিয়েছে। এই ছোট্ট কথার আড়ালে আদতে ঢাকা পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নতজানু নীতি, আমেরিকা বেজার হয়ে যাবে এই জুজু। এটা অপ্রত্যাশিত।

অথচ এই ফিলিস্তিনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক সেখানে স্বার্থের বিষয় জড়িত নয়। নির্ভেজাল বন্ধুত্বের এই সমর্থন, নিখাদ মানবতার উদাহরণ। বিশ্বইতিহাসের অন্যতম মহান নেতা প্রয়াত ইয়াসির আরাফাত বারবার বাংলাদেশে এসেছেন। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের সঙ্গেই ছিল ফিলিস্তিনিদের সুসম্পর্ক। এই সুসম্পর্কে বিভাজন এবার দেখা গেল আমেরিকা বেজার হয়ে যাবে এই জুজুতে বিএনপির কৌশলী অবস্থানে। এখানে স্বার্থের কাছে তবে পরাজিত হয়ে গেল মানবতা আর ঐতিহাসিক সম্পর্ক!

রক্তপাতের বিপরীতে কৌশলী অবস্থান কিংবা মধ্যপন্থা রক্তপাতকেই প্রকারান্তরে সমর্থন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভালোবাসা দেখালে, বন্ধুর (আমেরিকা) বন্ধুর (ইসরায়েল) বিপক্ষে গেলে যদি বন্ধু (আমেরিকা) বিরক্ত হয়; বন্ধু বিরক্ত হয়ে যদি ক্ষমতায় না বসায়—এই ভয় কি বিএনপির? বিএনপি যখন বলছে, পশ্চিমারা এবার তাদের সাহস যোগাচ্ছে, তখন এ প্রশ্নটাই মূর্ত হয়ে ওঠে!  অথচ বাংলাদেশ সবসময়ই ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের পক্ষে। রাজনৈতিক স্বার্থে যদি মানবতা ঢাকা পড়ে যায়, তবে এর মাধ্যমে দেশের মানুষের বিপক্ষেও যাওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর