বন্ধুত্ব, সমর্থন ও সহযোগিতার এক অনন্য নজির

, যুক্তিতর্ক

ড. দেলোয়ার হোসেন | 2023-10-26 14:30:13

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা এক শক্তিশালী বন্ধন হতে দুই দেশকে সহায়তা করছে। উভয় দেশের ভাষা, সাহিত্য, উত্সব, খেলাধুলা, শিল্প, ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং ধর্ম সহ অনেকগুলো সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলনে ব্যাপক সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলি একটি অভিন্ন পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, যা উভয় জাতির একে অপরের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধগুলি বোঝা এবং সম্মান প্রদান করাকে সহজ করে তুলেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালে, যখন ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার অবিচল সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল এবং এটি দুই দেশের মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি গঠন করেছে।

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কারিগর। তিনি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণকে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ক্ষেত্রে একত্রিতকরনের সময়। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং এর বাইরেও এর ব্যাপ্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির উপর ভিত্তি করে তাঁর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল যেখানে সংস্কৃতির বিচরন হবে মুক্ত ও নির্ভয়। জাতিসংঘে তার বাংলায় ভাষণ তার এক অনন্য নজির।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টি ছিল দুই দেশের জন্য এক স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে, যা তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রসারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে এই সময়ে। বাংলাদেশ ও ভারত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বহুদূর। তবে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অগ্রগতির এই সময়কাল সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সংকট অস্থিতিশীলতা যা ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পরিব্যপ্তি হয়েছিল বাধাগ্রস্ত।

১৯৯৬ সালে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শান্তি চুক্তি ও গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দিকে নতুন করে মনোনিবেশ করা হয়। ভারতীয় শিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা বাংলাদেশ সফর শুরু করেন এবং ভারতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা দেয়। আবারও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সম্পর্কের ক্রমোন্নতির ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার মাত্রাও হ্রাস পায়।

দুদেশের সম্পর্কের ধারাবাহিক বিস্তৃত অংশীদারিত্ব এবং গভীর বোঝাপড়া প্রচারের ক্ষেত্রে তাই অন্যতম কারণ হয়েছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গতিপথের একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন এবং সম্পর্ককে একটি নতুন দিকে নিয়ে যাওয়া উচ্চতা যা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে যার খাতসমূহ - নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংযোগ, কূটনীতি, সীমান্ত সম্পর্ক, পানি বণ্টন, এবং সংস্কৃতি। একের পর এক সম্মেলন এবং বৈঠকের পর বৈঠকের পর, ২০০৯ সাল থেকে সম্পর্ককে তার বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসা এবং গভীর আস্থায় রূপান্তরিত করেছে সহযোগিতা। এর পেছনে হাত ছিল সংস্কৃতির, তা বলাই বাহুল্য।

তবে উভয় দেশের গভীর সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই। মহান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ও ভারত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাদের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদারকরণের ক্ষেত্রে। একটি সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি ১৯৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, দু'দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় উভয় দেশ সাংস্কৃতিক বিনিময় (সি ই পি) পরিচালনা করতে সম্মত হয়। শিল্প ও সংস্কৃতি, গণমাধ্যম, চলচ্চিত্র ও সংবাদমাধ্যম, যুব ক্রিয়াকলাপ, প্রত্নতত্ত্ব, জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং শিক্ষা কার্যক্রম এইসবই এই চুক্তির আওতাভুক্ত ছিল। ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদের অধীনে চুক্তির উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিশন সিইপির অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য পর্যায়ক্রমে সভা করবে, এই মর্মেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

উল্লেখ্য এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, বাণিজ্য, ব্যবসা এবং সংযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন তিনি সবসময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি পৃথক সার্বভৌম দেশ হলেও সাংস্কৃতিক সংযোগ দ্বারা সংযুক্ত যা বিভিন্ন সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে।

ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (আইজিসিসি) ভারতীয় কাউন্সিলের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যা ১১ মার্চ ২০১০ উদ্বোধন করা হয়।  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সেমিনার, কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজনের মাধ্যমে উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ এবং পেশাদারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সাংস্কৃতিক সংযোগকে উত্সাহিত করে এই কেন্দ্র। উভয় দেশ শিক্ষার্থী বিনিময়েও অংশগ্রহণ করে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে। এর জন্য রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম। ভারত সরকার ২০০ টি বৃত্তি প্রদান করে আইসিসিআর স্কলারশিপ স্কিমের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। উভয় দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা সংলাপ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। প্রায় ৩০০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন।

উভয় দেশ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণকল্পে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে বাংলাদেশের শততম জন্মদিন ও ৫০তম বার্ষিকী, প্রখ্যাত ভারতীয় সংগীতশিল্পী এ আর রহমান বাংলাদেশের গীতিকার জুলফিকার রাসেলের সুরে 'জয় বাংলা' গানটি গেয়েছেন। এটি নির্দেশ করে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধন। যোগাযোগ উন্নত করা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণকে আরও কাছাকাছি আনার প্রচেষ্টায় এবং এটি একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার। গত এক দশকে, দুই দেশ বেশ কয়েকটি সংযোগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যেমন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চুক্তি এবং কলকাতা-খুলনা ট্রেন সার্ভিস ২০১৫ সালের চুক্তি। এছাড়াও বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, এবং ভারত (বিবিআইএন) চুক্তি সাক্ষর করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুপারিশ করেছেন ১০ বছরের কম বয়সী সকল বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার এবং ভিসা-অন-অ্যারাইভাল যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে “Liberation War Honour Award” যা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে।

বিশ্ব ইতিহাসে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত একই ব্যক্তির দ্বারা লেখা খুব বিরল। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এটা সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১-১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী এবং কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশের ৯০তম বার্ষিকী উভয় দেশ একত্রে সম্মানিত করে। এর বাইরেও কিছু নিয়ামক আছে যা বুঝতে সহায়তা করে দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতাকে।

সম্মোহনী নেতৃত্বের ইতিহাস

দুই দেশের সম্মোহনী নেতৃত্বের ইতিহাসও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করেন। একইভাবে, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারী বাজপায়ী সহ ভারতে অনেক সম্মোহনী নেতা ছিলেন। উভয় দেশের নেতৃত্ব তাদের সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইতিহাসের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা

বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে মোটামুটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই সময়ে, বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত অঞ্চলটি বিভিন্ন বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এই অঞ্চলটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরে ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই সময়ে, এই অঞ্চলে হিন্দু ও ইসলামী সংস্কৃতির একটি অনন্য মিশ্রণ আবির্ভূত হয়েছিল, যা আধুনিক বাংলাদেশে ও ভারতে এখনও স্পষ্ট।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধের এক অনন্য নিয়ামক। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে সংবাদ ও তথ্য সম্প্রচারে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রেডিও স্টেশনটি ভারতের কলকাতায় থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। একদল বাঙালি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ছিল এই কেন্দ্রটি। এই কেন্দ্রের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য ও এর মাধ্যমে বাংলাদেশীদের পরিচালিত কার্যক্রম নির্দেশ করে দুই দেশের মধ্যকার এক অটুট বন্ধনের।

অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিমূর্ত মূল্যবোধ ও ভাষা বাংলা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিমূর্ত মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠায় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অহিংসা, শিক্ষা, সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ সমতা, পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দেশপ্রেম, পরিবেশবাদ এবং মানবাধিকার তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলি দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস এবং বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতের সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করেছে। এটি অপরিহার্য যে উভয় দেশ এই মূল্যবোধগুলি প্রচার অব্যাহত রাখবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও বিকশিত হতে পারে এবং উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।

এছাড়াও, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত সরকারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ভারত বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সমর্থক এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করেছে। ভারতীয় শিল্পী এবং সংগীতশিল্পীরা নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করেন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রোগ্রামরয়েছে যা উভয় দেশের শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ধারণা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অনুমতি দেয়। তাছাড়া, দুই দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক বন্ধন হলো তাদের অভিন্ন ভাষা বাংলা। বাংলা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের কিছু অংশের সরকারী ভাষা। এটি বিশ্বের পঞ্চম সর্বাধিক কথ্য ভাষা এবং এর সমৃদ্ধ সাহিত্য এবং কবিতার জন্য বেশ সুপ্রসিদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশসহ বেশ কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবি রচিত হয়েছে।

বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অহিংসার চর্চা ও শিক্ষা মূল্যায়ন

উভয়ই সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের দিক থেকে বিস্তৃত দেশ। উভয় জাতির বৈচিত্র্যকে সম্মান করার এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রচারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই মূল্যবোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে উভয় দেশ একে অপরের সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সংস্কৃতিতে অহিংসা একটি অপরিহার্য অংশ। মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষার মধ্যে এই মূল্যবোধের মূল রয়েছে, যিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার হাতিয়ার হিসেবে অহিংসাকে ব্যবহার করেছিলেন। এখনও দুই দেশ এই মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল বক্তব্য পর্যন্ত- “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।” দুই দেশেই শিক্ষা বেশ সমাদৃত এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। উভয় দেশই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করে। দুই দেশের শিক্ষার্থীরা একে অপরের দেশে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে বলেই শিক্ষা দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রচারের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

সহিষ্ণুতার দীর্ঘ ইতিহাস

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই সহিষ্ণুতা একটি মৌলিক মূল্যবোধ। উভয় জাতির বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্মের মানুষের সাথে সহাবস্থানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উভয় দেশই একে অপরের বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের প্রতি সহনশীলতা এবং শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে আরেকটি দিক, উভয় দেশই প্রধানত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং শিখদের নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ ও ভারতের হিন্দু মন্দির ও মুসলিম মসজিদ দুই দেশের অভিন্ন ধর্মীয় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। তদুপরি, উভয় দেশ দুর্গা পূজা, ঈদ এবং দীপাবলির মতো ধর্মীয় উত্সব উদযাপনের ঐতিহ্য ভাগ করে নেয়।

নারীর ক্ষমতায়ন, পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষা উভয় দেশই নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। এই মূল্যবোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ নারী অধিকার প্রচার এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে আসছে একযোগে। পারিবারিক মূল্যবোধ বাংলাদেশী এবং ভারতীয় উভয় সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। দুই দেশেই পারিবারিক মূল্যবোধের একটি শক্তিশালী চর্চা পরিলক্ষিত হয়। এই মূল্যবোধ দুই দেশের সংস্কৃতির মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। উভয়ই সামাজিক বৈষম্য মোকাবেলা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়, এক দেশের জনগণের প্রতি অন্য দেশের জনগণের ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা, কেননা এর চর্চা যে তারা পায় একেবারে শৈশব থেকেই।

দেশপ্রেম, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবাদ

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই দেশপ্রেম একটি মৌলিক মূল্যবোধ। উভয় দেশেরই তাদের দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা রয়েছে এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে। এই বোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ তাদের দেশের স্বার্থ এবং মূল্যবোধপ্রচারের পাশাপাশি সম্মান দেখায় অপরের অনুভুতিরও। উভয় দেশেই পরিবেশবাদ গুরুত্ব পায় ব্যপক পরিসরে। সাথে যুক্ত আছে টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর প্রদান। এই বিষয়দুটি তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ পরিবেশগত সমস্যাগুলি মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নে একযোগে কাজ করে চলেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত। দুই দেশের মধ্যে একটি ইতিহাস, রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন রয়েছে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, উভয় দেশ বছরের পর বছর ধরে একটি শক্তিশালী বন্ধন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনের আরও কিছু নিয়ামক অন্বেষণ করা যায়, তাদের সম্পর্ককে রূপ দানকারী অভিন্নতাগুলকেও নেয়া হবে যাচাইয়ের ছাঁচের ভেতর দিয়ে।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আরেকটি সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলন হ'ল তাদের রন্ধনপ্রণালী। উভয় দেশই মশলাদার এবং স্বাদযুক্ত খাবারের প্রতি ভালবাসা ভাগ করে নেয়, ভাত তাদের প্রধান খাবার। সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে বিরিয়ানি, সামোসা এবং ডাল। সরিষার তেল, জিরা এবং ধনিয়া সহ মশলার অনন্য ব্যবহারের জন্য বাঙালি রন্ধনপ্রণালী পরিচিত। উপরন্তু, উভয় দেশ চায়ের প্রতি ভালবাসাও দেখাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, তাই চা উভয় দেশে একটি জনপ্রিয় পানীয়।

সঙ্গীত ও নৃত্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাউল সঙ্গীত ও  যাত্রা এর মতো লোকসংগীত এবং নৃত্য উভয় দেশেই জনপ্রিয়। ভরতনাট্যম, কত্থক এবং মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যও বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই জনপ্রিয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার মতো অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দুই দেশ একযোগে কাজ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে একসাথে কাজ করে যাচ্ছে।

এ যেন এক অনন্য বন্ধন: বন্ধুত্ব, সমর্থন ও সহযোগিতা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনের একটি অনন্য ও শক্তিশালী ইতিহাস রয়েছে যা প্রাচীন। এই সম্পর্কটি বন্ধুত্ব, সমর্থন, সহযোগিতা এবং গৌরবের মুহুর্তগুলির সাথে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এই সম্পর্ক একটি গভীর ও স্থায়ী বন্ধুত্বেরও প্রতীক, যা অভিন্ন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রচারের জন্য পারস্পরিক অঙ্গীকারের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। দুই দেশের সরকার এই সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনের সময় একে অপরের পাশে থেকেছে অবিচল সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে।

এছাড়াও তাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুই দেশ এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একসাথে কাজ করেছে। অবধারিতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হাজার বছরেরও বেশি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উভয় দেশ অভিন্ন ইতিহাস, রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী বন্ধন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কূটনীতির শক্তির সাক্ষ্য বহন করে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার পর ভারতই প্রথম বৃহৎ রাষ্ট্র যেটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন একটি ইতিবাচক লক্ষণ, এবং আশা করা যায় যে উভয় দেশ তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রচারের জন্য একসাথে কাজ চালিয়ে যাবে যেখানে সংস্কৃতি পালন করবে মুখ্য ভুমিকা, যা বলাই বাহুল্য। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী উত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কিংবা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অনাস্থা ও বৈরিতা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বন্ধন আরও সুদৃঢ় করবে এবং একসঙ্গে এগিয়ে চলার পথকে করবে আরও মসৃন ও সুন্দর।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী বিশেষজ্ঞ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর