২৮ অক্টোবর: দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ও দলীয় সতর্কতা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-10-27 20:32:24

মানুষ জৈবিকভাবেই স্মৃতিকাতর। সুখস্বপ্ন তাকে প্রতিনিয়ত আচ্ছন্ন ও আপ্লূত করে। দুঃস্বপ্ন যন্ত্রণা দেয়। দুঃস্বপ্নের কাছ থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়ায়। ভুলে যেতে চায় দুঃস্বপ্নের কৃষ্ণপ্রহর।

ব্যক্তিজীবনের মতোই জাতীয়জীবনের বহু ঘটনা মানুষকে উদ্বেলিত করে কখনো আনন্দে, কখনো বিষাদে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৮ অক্টোবর তেমনি একটি ভীতি ও বিষাদের দিন। মৃত্যু ও তাণ্ডবের দিন। ২০০৬ সালে এই দিনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীরা ঢাকায় লগি-বৈঠার মিছিল ডেকেছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাজপথে নেমে বিএনপি-জামায়াত ও পুলিশের সম্মিলিত শক্তিকে প্রতিহত করা। শক্তির বলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাওয়া বিএনপি সরকারকে পাল্টা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই ক্ষমতার আসন থেকে উৎখাত করাই ছিল বিরোধী দলগুলোর উদ্দেশ্য।

নিকটঅতীতের সেই ভয়াবহ ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালের দুঃসহ স্মৃতি আবার যেন ভীতি জাগাচ্ছে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সালে। সেদিন পল্টন-গুলিস্তান এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নেয়। সারাদেশে নিহত হয় কমপক্ষে ১২ জন। লগি, বৈঠা ও পিস্তলসহ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা যায় বিবদমান দলীয় কর্মীদের।

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ‘যে কোনো’ উপায়ের আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটও ‘যে কোনো’ উপায়ে তা ঠেকাতে মরিয়া ছিল। 'পয়েন্ট অব নো রিটার্নে' যুযুধান দুই জোটের রক্তাক্ত দ্বৈরথে পুরো দেশ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছিল। দেশে গণতন্ত্রের নাজুক দশার ধারাবাহিকতায় জারি করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে রোপিত বিভেদ ও সহিংসতার বীজ বৃষবৃক্ষে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নাস্তানাবুদ করছে এখন পর্যন্ত। প্রকৃত দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ যাত্রাপথ কণ্টকাকীর্ণ হয়েই রয়েছে। রাজনীতি চলছে হিংসা, অনৈক্য ও থেমে থেমে শক্তি প্রয়োগের পথে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি নির্ভেজাল গণতন্ত্রকেও আর প্রকৃত স্বরূপে ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না।

১৭ বছর পরে আরও একটা ২৮ অক্টোবরে প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে নাকি দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফিরে আসবে? বিরোধী দল বলছে, এই দিনটাই হবে ‘টার্নিং পয়েন্ট’। আওয়ামী লীগের ‘পালানোর কোনো পথ নেই, তাদের সময় শেষ।’ আওয়ামী লীগের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার খায়েশ পূরণ হবে না।’ এমতাবস্থায় টান টান উত্তেজনায় কম্পমান রাজনীতি। উভয় পক্ষের নেতাকর্মীরা সমবেত হতে শুরু করেছে। থমথমে অবয়ব পেয়েছে রাজধানী ঢাকা। চারিদিকে আতঙ্ক ও ভীতি। ২৮ অক্টোবর কী হয়, কেউ জানে না।

২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালের দুঃস্বপ্নের স্মৃতির আলোকে দলীয় সতর্কতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। মুখে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কতটুকু নিশ্চিত করা হবে তা বলা দুষ্কর। উগ্র ও উত্তেজিত কর্মীবাহিনী হলো গ্রিক পৌরাণিকের ট্রোজান হর্স কিংবা ভারতীয় মিথের অশ্বমেধের ঘোাড়ার মতো। লাগামছাড়া হয়ে একবার ছুটে গেলে তাকে আর বশ মানানো যায় না। ২৮ অক্টোবর কি তেমনি এক বিপদসংকুল পরিস্থিতির অভিমুখে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি?

আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতার পথে চললে হয়ত এমন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হওয়ার দরকার পড়তো না। কিন্তু একটি বারের জন্যও আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতা লক্ষ্যে দুইপক্ষ বসতেই পারে নি বা বসার প্রয়োজনই বোধ করেনি। বরং পরিস্থিতিকে টেনে নিয়ে এসেছে ২৮ অক্টোবরের অগ্নিগর্ভ ও অনিশ্চিত উপসংহারে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ঘিরে দিয়েছে বিপদের সঙ্কুলতায়।

কিন্তু মানুষ তো দুঃস্বপ্নের স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায় না। মানুষ বিষাদ ভুলে হর্ষের উদ্বোধন দেখতে চায়। ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ছুঁয়ে-আসা ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সালে মানুষ বিবদমান দলগুলোর কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা চায়, দুঃসহ কৃষ্ণপ্রহরের রক্তযুক্ত প্রত্যাবর্তন দেখতে চায় না।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর