নতুন প্রজন্ম: যাদের ভোটে নির্ধারণ হতে পারে জয়-পরাজয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-24 05:23:41

 

নতুন প্রজন্ম যাদের ইংরেজিতে বলা হয় নিউ জেনারেশন। বাংলাদেশে এই শ্রেণির এখন বাড়বাড়ন্ত। দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই যুবসমাজ যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। এরাই কিন্তু আগামী নির্বাচনের মূল সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, যদি এই তরুণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, তাহলে কিন্তু এই প্রজন্মই পারে ‘গণেশ উল্টে’দিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ক্ষেত্রে মূল ফ্যাক্টর এই নতুন প্রজন্মের ভোট।

এই প্রজন্ম সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত প্রবীণরা একটা ট্যাগলাইন সেঁটে দিয়েছেন। নতুন প্রজন্ম একটু ‘অস্থির’। একইসঙ্গে একটু ‘উদাসীন’প্রকৃতির। জগৎ-সংসারের কিছুতেই কিছু এসে যায় না। নিছক ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণলক্ষ্যে মগ্ন, পাশের বাড়ির অগ্নিকাণ্ডেও প্রবল নিস্পৃহ। কেন? বিশ্বায়নের রঙিন লোভ, না কি রাজনৈতিক হয়ে পড়ার ভয়? রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি সর্বময় এক বিশ্বাসহীনতা, না কি দীর্ঘদিন প্রতাড়িত হওয়ার কারণে সৃষ্ট উদ্যোমহীনতা? তীব্র প্রতিযোগিতা আর আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট এক ধরনের বৈরাগ্য? না কি এই সব কিছুই একসঙ্গে খেলা করে যায়, এই বাংলার নতুন প্রজন্মের রক্তের ভেতরে?

এই নতুন প্রজন্ম নিয়ে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। তারা ঠিক কেমন, তাদের চাহিদা বা প্রত্যাশা কি, সেটা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বিজ্ঞানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো গবেষণা নেই। আধুনিক যন্ত্রপ্রযুক্তি নির্ভর এই নতুন প্রজন্মের রয়েছে তাৎক্ষণিক চাহিদা মিটে যাওয়ার বাতিক। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ক্রিকেট, ইরোপীয়ান ক্লাব ফুটবল, ইউটিউব, ফেসবুক-এই হচ্ছে নতুন প্রজন্মের প্রধান আকর্ষণ। এরা ক্যাশলেসও বটে। যখন যা ইচ্ছে, এরা অনলাইনে কিনে ফেলে। নগদ টাকা না থাকলেও অসুবিধা হয় না। এজন্য ক্রেডিট কার্ড আছে, পেমেন্ট অন ডেলিভারি আছে, ইনস্টলমেন্টের সুবিধা আছে; আর একদিনের মধ্যেই সাধারণত জিনিসটা বাসায় চলে আসে। কেউ সিনেমা দেখতে চাইলে ইউটিউব বা অন্য মিডিয়াতে সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পারে, কিংবা পে-চ্যানেলে গিয়েও দেখতে পারে। সিনেমাটা কাছের সিনেমাহলে আছে কি নেই নেই, শো-এর টাইমটেবল, টিকেট আছে কি না – এসব নিয়ে কোনো ঝামেলাই নেই। একটা টিভি সিরিজ দেখার ইচ্ছে হলে সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেটে সেটা দেখে ফেলা যায়। পরের পর্বের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস অপেক্ষার ফলে সহিষ্ণুতার যে শিক্ষা সেটার কোনো বিষয়ই আর নেই এখন। কেউ কেউ তো আবার এতই অধৈর্য যে, মাঝের পর্ব বাদ দিয়ে একেবারে সিজনের শেষ পর্ব দেখে ফেলে।

এমনকি, কাউকে ‘প্রপোজ’ করাটাও এখন এঁরা শিখতে পারে না। কীভাবে হাত ঘষে ঢোক গিলে বোকা বোকা কথা শুরু করবে ডিজিটাল যুগে এ ধরনের সামাজিকতা শেখারও প্রয়োজন নেই। ডেটিং সাইটে গিয়ে শুধু ক্লিক করলেই সব ঠিক। এই যুগে যাই চাওয়া হয়, সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়, শুধু যা পাওয়া যায়না সেটা হল– পেশাদারিত্ব আর গভীর সম্পর্ক। কারণ, এগুলোর জন্য কোন অ্যাপ নেই। এগুলো অর্জন করতে হয় ধীরগতিতে, আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথে– যা পেরোতে দরকার ধৈর্য আর একাগ্রতা। কিন্তু এই প্রজন্মের এই অর্জনগুলোর জন্য যে প্রশিক্ষণের দরকার-তা নেই। কর্মস্থলে গিয়ে এরা হতাশ হয়, গভীর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়, পিছিয়ে যায়: কারণ ধৈর্য ধরে সফলতার জন্য অপেক্ষা আর লেগে থাকা, তিল তিল করে সফলতার ভিত্তি গড়ে তোলা বা কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চর্চা- এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এরা পায় না। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে চূড়াতে যাওয়ার কামনার মত– এঁরা শুধু চূড়া দেখে আর সরাসরি সিরিয়ালের শেষ পর্ব দেখার মত স্টাইলে সেখানে যেতে চায়।

কিন্তু বাস্তব তো এমন নয়: এর জন্য পাহাড় ডিঙানোর পরিশ্রম, ধৈর্য, পরিকল্পনা, দক্ষতা এইসব দরকারি বিষয়গুলোর কোনো ধারণাই এদের মধ্যে থাকে না। ফলাফল হতাশা আর হীনমন্যতা। নতুন প্রজন্মের একটা অংশ রোবটের মত একঘেয়ে একটা জীবন পার করছে কিন্তু কখনই জীবনের আনন্দঘন দিকগুলো সেভাবে উপভোগ করতে পারছে বলে মনে হয় না। তাদের মধ্যে জীবনবোধের গভীরতা কিংবা পরিপূর্ণতার অনুভূতিও খুব একটা দেখা যায় না। বাব-মার উদাসীনতা, সমাজ-ব্যবস্থার ভুলের ফলে এই প্রজন্ম ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক, অসহিষ্ণু এবং অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে– অথচ তার দায় কেউ নিতে রাজি হয় না।

আজকে যে তরুণ পাহাড়ের গোড়া থেকে এক লাফে চূড়ায় পৌঁছাতে চাইছে সে কয়েক প্রজন্ম ধরে একটু একটু করে উপত্যকার গহ্বরে নেমেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দুর্বৃত্তায়ণ তাকে এটা বুঝতে শিখিয়েছে এখানে চাইলেই এক লাফে পাহাড়ের চূড়ায় উঠা যায়। এখানে জ্ঞানলাভ না করেও বিপুল অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা আর মর্যাদার অধিকারী হওয়া যায়।

এই নতুন প্রজন্ম এমন একটা সমাজে বড় হচ্ছে যেখানে ঘুষ খাওয়াটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। মূল্যবোধের বিকাশকে সমাজ মূল্যায়ন করে না। এমন একটা সেন্সরড শিক্ষা ব্যবস্থা দেয়া হচ্ছে যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মেধা বিকাশের কোনো সুযোগই নেই। এমন অভিভাবক তারা পাচ্ছে যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সন্তানের হাতে তুলে দিতে দু'বার চিন্তা করে না। এমন প্রজন্ম আর কেমন হতে পারে?

আমাদের এক শ্রেণির মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দ্রুত টাকা বানাতে পেরেছে। এই শ্রেণির টিভি-ফ্রিজ কেনার জন্য টাকা জমাতে হয় না। গাড়ি কেনার জন্য ব্যাংক লোন এখন সহজেই পাওয়া যায়। সম্মান বজায় রাখার জন্য হলেও মালয়েশিয়া ঘুরতে যায়, কারণ সবাই যাচ্ছে, নিজের ভ্রমণপিপাসা না থাকলেও। এই শ্রেণি বাচ্চাকে ছবি আঁকার ক্লাসে নিয়ে যায়, কারণ পরীক্ষায় অঙ্কন বিষয়টায় নম্বর তোলা জরুরি, বাচ্চাটা ছবি আঁকতে পছন্দ করে কী না সেদিকে খেয়াল করার বিলাসিতা কই?

এমন পরিবার, চিন্তাচেতনা সমৃদ্ধ অভিভাবকদের হাতে গড়া এই নতুন প্রজন্মের যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোর জন্য আসলে আমরাই দায়ী সামষ্টিকভাবে। এই যুগে জন্মনেয়া বাচ্চাদের ডিএনএ-তে কোনো আকস্মিক মিউটেশন হয়নি-যে কারণে তারা আলাদা। বরং, তাদের চারপশের পরিবেশটা আলাদা। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল সেই পরিবেশটা আমরাই তৈরি করেছি।

এই ট্রেন্ডি, কিছুটা ধর্মীয় চেতনা, কিছুটা লিবারেল, ক্যাশলেস আরবান যুব নারী-পুরুষ নিয়ে নয়া বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে৷ এই যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন ক্যাফেতে আড্ডা দেয়, ফাস্টফুডের দোকানে খাবার খায়, অনলাইনে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে শপিং করে৷ হাসিনা-কামাল-খালেদা-তারেক কী করল কী বলল, তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা কোনো মন্ত্রীর কারণে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হলে, তারা রাগ করে৷ এই প্রজন্ম অতীতে কে, কি করেছে-এই হিসেবের চেয়ে এখন কে কী করছে, কতটা ভালো করছে, সে ব্যাপারে মাথা ঘামায় বেশি। ফলে তাদের ভোটটা সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষেই যায়।

এখানে একটি কথা বলা ভালো যে, কোটা সংষ্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সরকারি দলের ভূমিকা নতুন প্রজন্মকে খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বরং সরকারি দলের অপরিণামদর্শী আচরণ তাদের প্রতিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দিয়েছে।

গণতন্ত্রে কারা আমাদের সঙ্গে আছে সেটিতে আত্মতুষ্ট হওয়া কিন্তু রাজনৈতিক কুশলতা নয়। বরং বিশ্লেষণ করতে হয় কারা সঙ্গে নেই এবং কেন নেই! কিন্তু ক্রমেই আমাদের দেশটি চলে যাচ্ছে হাইপার ন্যাশনালিজমের এক ফাঁদে। আগামী দিনে আরও বেশি করে প্রতিটি সরকারি সিদ্ধান্তের গায়ে আটকে দেওয়া হবে একটি করে অদৃশ্য লেবেল, যেখানে লেখা থাকবে দেশের ভালোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিরোধিতা করলেই তুমি দেশদ্রোহী। সুতরাং ক্রমেই বাংলাদেশ এমন যুগে ঢুকে যাচ্ছে যেটি দেখতে গণতন্ত্রের মতো। কিন্তু আসলে সেটি হল ‘ইয়েস গণতন্ত্র’। ‘হ্যাঁ’ বললে দেশপ্রেমী। ‘না’ বললে দেশদ্রোহী! এর নাম ‘ইয়েস গণতন্ত্র।’ এই গণতন্ত্র অনেককেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে।

যাহোক, এই ‘অ্যাপস-নির্ভর’ নতুন প্রজন্মের সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এর বাইরে আরও একটা প্রজন্ম আছে যাদের কথা কখনও কেউ শোনেনি। প্রত্যন্ত বাংলাদেশ। যারা অ্যাপসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। তারা কী ভাবছেন? সেটা কিন্তু জানা যাচ্ছে না। কারণ, তারা আমাদের কাছে আসে না। আমরাও তাদের কাছে যাই না। সেতুও নেই। সংযোগও নেই।

তারা এবার কাকে ভোট দেবেন? তাদের সিদ্ধান্তের ওপরই কিন্তু নির্ভর করছে জয় পরাজয়। অবশ্য এখানে আরও বড় ফ্যাক্টর রয়েছে, তা হলো-যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। যদি এই প্রজন্ম তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অবাধ সুযোগ পায়। 

চিররঞ্জন সরকার : কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর