নির্বাচনী প্রচার: দেয়াল থেকে ওয়ালে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-30 18:19:47

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় এবার যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। অনলাইন ও ডিজিটাল গণমাধ্যম ব্যবহার করে প্রার্থীরা তাদের প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই প্রচারণা যে শুধু প্রার্থীরাই চালাচ্ছেন তা নয়, প্রার্থীদের সমর্থকরাও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারাও নিজ দলের প্রার্থীদের পক্ষে সামাজিক গণমাধ্যমে ভোট চাচ্ছেন। অনেক নেতা ও প্রার্থীদের মাঠে দেখা যায়নি। কিন্তু ঘরে খিড়কির দরজা বন্ধ করে ঠিকই সামাজিক যোগাযোগে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় মস্কোতে বৃষ্টি হলে কলকাতার কমিউনিস্টরা ছাতা ধরতো। হালে লন্ডনে কেউ বক্তৃতা দিলে বাংলার ঘরে ঘরে হাত তালির রব ওঠে। আসন্ন নির্বাচনেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। প্রার্থীরা এলাকায় নেই, হয়তো এখন পাতাইয়া, লঙ্কাউয়ে বা সিঙ্গাপুরে সময় কাটাচ্ছেন, অথবা কোনো মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলেও থাকতে পারেন, কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে তারা ঠিকই সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন। সমর্থকরা তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে বা দেখে হাত তালিও (লাইক) দিয়ে যাচ্ছেন। পছন্দ না হলে দু’চার কথা শুনিয়েও দিচ্ছেন (কমেন্ট করে)।

কম খরচে সব ভোটারই শুধু নয় সবার কাছেই (যাদের দোয়া চাওয়া হয়) পৌঁছে যাওয়ার এ এক অভিনব উপায়। অধিকাংশ প্রার্থীরাই এর ব্যবহার করছেন। ডিজিটাল মিডিয়া তথা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবন যাত্রার নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। নির্বাচনী প্রচারণাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। আজ থেকে দুই দশক আগে আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম ও আজকের যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ইন্টারনেট বলি আর টেলিযোগাযোগ বলি সবই আকাশ মাধ্যমের যোগাযোগ। জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো নির্বাচনেও তাই আমরা দেখি অনলাইন, ডিজিটাল মাধ্যম তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। এবং বাস্তবতা হচ্ছে এর ব্যবহার রোধ করা যাবে না, প্রয়োজনও নেই।

আমাদের নির্বাচন প্রচার সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাইক ও পোস্টার। এখনও এর ব্যবহার উঠে যায়নি সত্য। তবে রিকসা বা গাড়িতে মাইকিং করে প্রচার হয়তো খুব বেশি দিন চলবে না। শোডাউনের জন্য শুধু দুয়েকটি সভা-সমাবেশে মাইকের ব্যবহার হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যতো মাইক ব্যবহার হয়েছে আমার ধারণা এবার নির্বাচনে ততো মাইক ব্যবহার হচ্ছে না। যদিও এবারে নির্বাচনে বিরোধী জোট মাঠ গরম করার পর্যায়ে নেই। তাই তাদের প্রচারও নেই। ২০১৪ সালের ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন। তবে, পোস্টারের অপরিহার্যতা ধীরে ধীরে কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

যদিও আমাদের বিদ্যমান নির্বাচনী আইন আগের মতোই চলছে। ট্র্যাডিশনাল প্রচার ও প্রচারণার কৌশল ও মাধ্যম বিবেচনা করেই আইন করা হয়েছে। হালের ডিজিটাল প্রচারণার কৌশল এখনও আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এমনকি সংশোধিত আচরণবিধিতেও ডিজিটাল বা অনলাইন দুনিয়ার বাস্তবতার দিকে কর্তৃপক্ষের নজর ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন।

এখন প্রার্থীরা শুধু ‘আমাকে ভোট দিন’ মার্কা কথা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। অনেক টাকা ও লোকবল খরচ করে সমাবেশ করার দিন প্রায় শেষ। দেখা যায় কোনো প্রার্থী সমাবেশ আয়োজন করার পরে সেখানে দুই’শ লোকও হাজির হয় না। যে হাত তালি দেয়া হয় তাতে পয়সা উসুল হয় না। এটা প্রার্থীদের জন্যও কষ্ট ইভেক্টিভ হয় না। তারপর আবার নির্বাচন কমিশনের কাছে যদি মনে হয় যে প্রার্থী তার ব্যয়সীমার চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছে সেটি আবার আরেক যন্ত্রণা। এছাড়া নানা সুশীল গবেষকরা ওত পেতে আছে এসব ধরার জন্য। তাই শুধু একটি ফেসবুক একাউন্টই সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। টাকা পয়সা খরচেরও বালাই নেই। একটা ফেসবুক একাউন্ট ও একটা মোবাইল-বাস প্রচার প্রচারণার আর ঝামেলা নেই।

অনেক প্রার্থীই ইতোমধ্যে তার সমর্থকদের জন্য ফেসবুকে বক্তব্য প্রদান করেছেন ও সমাবেশে যাওয়ার বদলে নিজের বৈঠকখানার এক কোনো বসে বক্তব্য প্রদান করছেন। আর সেই বক্তব্য গিন্নির মাধ্যমে ধারণ করিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন। এই শীতে নিজেকেও বাইরে আসতে হলো না, পয়সাও খরচ হলো না, আবার সমর্থক-ভোটারদের কাছে প্রচারণাও চালানো গেলো।

এই যেমন গোলাম মাওলা রনি। খবরে দেখলাম তিনি দাবি করেছেন যে বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকদের হুমকির তিনি ভয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। গৃহবন্দী হয়ে আছেন কয়েক দিন। মসজিদে নামাজ পড়তেও যেতে পারেন না। সন্ত্রাসীরা তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। কিন্তু তাতে কি! তার প্রচার প্রচারণাতো থেমে নেই। ফেসবুকে তিনি যাবতীয় বিষয় বয়ান করেছেন ও সেই সাথে তার সমর্থকদের কাছে ভোটও চেয়েছেন। সেই সাথে তিনি তার সমর্থক ও এজেন্টদের উদ্দেশে তারা ভোটের দিন কী কৌশল অবলম্বন করবেন তারও বয়ান করেছেন। এসব করতে তাকে ঘরের বাইরে আসতে হয়নি।

দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। তাদের অর্ধেকের বেশি লোক আবার ভোটার। কাজেই ভোটারের কাছে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় ফেসবুকের মাধ্যমে। পয়সা খরচ করে লোক লস্কর ডেকে সভা সমাবেশ করার দিন শেষ। এছাড়া পদে পদে প্রতিপক্ষের বাধা বিপত্তির ঝামেলা নেই। মামলা থাকলেও হামলা নেই। কিন্তু ফেসবুকে এসবের কোনো কিছুই নেই। ভিডিও করু, শেয়ার করুন।

পোস্টারে যা লেখা যায় না, বলা যায় না তার সব কিছুই এখানে বলা সম্ভব। এছাড়া সভা-সমাবেশে এক কথা বলতে গিয়ে আরেক কথা বলে ফেলার একটা বিষয় আছে। মানুষকে এখন অনেক হিসেব-নিকেশ করে কথা বলতে হয়। কথা হলো বন্দুকের গুলি। একবার বের হলো তা ফিরে আসে না। বেফাঁস কথা বলার জন্য হালে অনেকেই সমালোচিত হয়েছেন, অনেকে জেল খেটেছেন, অনেকে জামিনে আছেন। কিন্তু ভিডিওতে কিছু বললেও তা সম্পাদনা বা কাটাছেঁড়া করে পোস্ট করার সুবিধা আছে। কেউ চাইলে লাইভেও যেতে পারেন। এভাবে এর সুবিধার অন্ত নেই। অসুবিধা কিছু নেই তা নয়। তবে সুবিধাই বেশি।

অতি সম্প্রতি গুজবের একটি ব্যাপার গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমকে কাপিয়ে দিয়েছে। গুজবের কিছু রক্তাক্ত অধ্যায়ের আমাদের নিকট অতীতে সংঘটিতও হয়েছে। অনেকে সামাজিক গণমাধ্যমের অসাধু ব্যবহার করেছেন এটাও ঠিক। কিন্তু বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। নির্বাচন তথা জীবনযাত্রায় ডিজিটাল মাধ্যমকে অস্বীকার করা উপায় নেই। এবং এটাই আজ ও আগামীর বাস্তবতা।

নির্বাচন কমিশন বলছে তারা সামাজিক যোগাযোগে নজর রাখছে। যদিও এটা তাদের পক্ষে এখনও সেভাবে করা সম্ভব না। ৩০০ প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা কে কী পোস্ট করছে তার দিকে নজর রাখা সহজ কাজ না। এছাড়া বিদ্যমান আইনে বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়নি। এমুহূর্তে সেটি সম্ভবও না। কেউ যদি রিপোর্ট করে তবে হয়তো তারা একটা ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেটি করতেও তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন, প্রয়োজন লোকবল। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা। শুধু একটি বিষয় খেয়াল রাখা আপাতত জরুরি যে কেউ যাতে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়াতে না পারে। ইতিবাচক প্রচারণা চালালে সমস্যার হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনের হাতে আছে আর পাঁচ দিন। এর মধ্যে বেশি কিছু করা সম্ভব না। তবে নেতিবাচক প্রচারণার প্রতি একটু নজরদারি রাখাই উচিত।

বিদ্যমান আইনের আরেকটি সমস্যা আছে তা হলো ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। মাইকিং করা, পাড়া-মহল্লায় যাওয়া না হয় বন্ধ হবে। কিন্তু ফেসবুকে যা পোস্ট করা হয়ে গেছে তা কি সবাই ডিলিট করে দেবে? না। তা দেয়ার প্রয়োজনও নেই।

আমাদের বিদ্যমান নির্বাচনী আচরণবিধিমালা ২০০৮ (২০১৩ সালে সংশোধিত)-তে পোস্টার-ব্যানার নিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তা লক্ষ করা যাচ্ছে। কমিশন জানে, দেয়ালে পোস্টার লাগানো হয়। তাই তারা দেয়ালের সংজ্ঞা বিস্তৃত করেছে। বিধিতে আছে, দেয়াল অর্থ বাসস্থান, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্প কারখানা, দোকান বা অন্য কোনো স্থাপনা, কাঁচা বা পাকা যাই হোক না কেন, এর বাইরে ও ভেতরের দেওয়াল বা বেড়া বা তার সীমানা নির্ধারণকারী দেয়াল বা বেড়া এবং বৃক্ষ, বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি, খাম্বা, সড়ক দ্বীপ, সড়ক বিভাজক, ব্রিজ, কালভার্ট, সড়কের উপরিভাগ ও বাড়ির ছাদ ও দেয়াল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সময় বদলে গেছে। আমারা বাড়ির ছাদে যাতে পোস্টার লাগানো না হয় সে জন্য শক্ত আইন করেছি। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি, নির্বাচনী প্রচারণা এখন দেয়ালে বা বাড়ির ‘বেড়া’তে নেই, যা আছে তাও থাকবে না । সময়ের সাথে সাথে এখন তা প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়ালে প্রকাশ পাচ্ছে।

এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো আগামী দিনের আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আচরণবিধিতে সমসাময়িক বিষয়গুলোকে এড্রেস করতে হবে। এক্ষেত্রে উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিই কাম্য। নিয়ন্ত্রণবাদী আইন ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। কারণ দেয়ালের সীমা এখন অনেক বিস্তৃত, বিশ্বব্যাপী। দেয়াল আর ওয়ালের মাঝে পার্থক্য অনেক, দূরত্ব ব্যাপক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর