বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টা: সাবধান, সামনে অনাহুত!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-10-30 11:39:29

২৮ অক্টোবর বহুল আলোচিত দিনের নানা ঘটনাপ্রবাহের পর এক রহস্যময় ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলন করে গেলেন বিএনপির কার্যালয়ে। নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ দাবি করা ওই ব্যক্তি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে রেখে কথা বললেন। জানালেন, দিনের সবকিছু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানেন। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন, আওয়ামী লীগ সরকার আর কতদিন ক্ষমতায় থাকবে সেটাও।

বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একজন উপদেষ্টা বিএনপির কার্যালয়ে এসে এভাবে কথা বলবেন, এটা ছিল ধারণারও বাইরে। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ্য হয়েছে। জানা যাচ্ছে, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা নন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ওই ব্যক্তির সম্পৃক্ততার বিষয়কে ‘মিথ্যা’ বলে মন্তব্য করেছে। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আরাফি নামে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি বাংলাদেশ নেই। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কোনো তৎপরতার বিষয়টি গুজব, সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল’।

রোববার জো বাইডেনের কথিত ওই উপদেষ্টা ঢাকায় আটক হয়েছেন। বাংলাদেশ ত্যাগের সময়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরাফি শনিবার বিএনপি কার্যালয়ে যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তখন উৎসুক চোখগুলো তাকে ঘিরে রেখেছিল। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যে বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলোও বিএনপির চাওয়ার সঙ্গে মিলে যায়। একবার নয়, দুই-দুইবার কথা বলেছেন তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনই কেবল নন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীও ছিলেন কার্যালয়ে। আরাফি বলেছেন, ‘শনিবার যা হয়েছে তার আগাগোড়া আমেরিকা জানে। বিএনপির সমাবেশ পণ্ড করার পেছনে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেওয়া হবে’। তার দাবি কিংবা পূর্বাভাস, ‘৩ নভেম্বরের পর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না’!

রহস্যময় ওই ব্যক্তি আসলে কে—এ এনিয়ে সন্দেহ আর প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। কীভাবে তিনি বিএনপি কার্যালয়ে গেলেন, কীভাবেই বা তিনি সংবাদ সম্মেলনের সুযোগ পেলেন—এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, ‘এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না‘। যে রুহুল কবীর রিজভী মিঞা আরাফির সঙ্গে ছিলেন বিএনপি কার্যালয়ে তিনিও জানেন না কিছু দাবি করছেন। যে ইশরাক হোসেন মিঞা আরাফির পাশে বসা ছিলেন, তিনিও এখন তাকে না চেনার ভান করছেন। বলছেন, ‘সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী ওই ব্যক্তির সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাদের পাশে বসা ছাড়া তার প্রত্যক্ষ কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।’ ওই ব্যক্তির আসল পরিচয় ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কারো জানার আগ্রহ থাকলে নিজ উদ্যোগে খোঁজখবর নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন ইশরাক।

জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরাফিকে এখন বিএনপির কেউ চিনতে পারছে না। অথচ কী আশ্চর্য বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় পেয়ে তারা তার পরিচয় নিশ্চিতের চেষ্টাই করেনি। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অবাকই করেছে আমাদের। কেউ এসে কিংবা কেউ কাউকে নিয়ে এসে বাইডেন কিংবা অন্য কারো উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়াই কি যথেষ্ট? এমন না যে বাংলাদেশে আমেরিকা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কোন মাধ্যম নেই। তারা ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত, এবং অথবা অনলাইন মাধ্যমের সহায়তা নিতে পারত।

বিএনপি কি নিজেদের মতো করে আমেরিকাকে ভেবেছে? তাদের ‘চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা’ নামে অগণন উপদেষ্টার মতোই আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও অগণন উপদেষ্টা? আর জো বাইডেনের অবস্থা কি এতখানি খারাপ হয়েছে যে তার কোন উপদেষ্টাকে সংবাদ সম্মেলন করতে বিএনপির কার্যালয় পর্যন্ত ছুটে যেতে হয়? দেশের নানা প্রান্তে নানা বয়সের বয়েসিরা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়ে রয়েছেন, জো বাইডেনের উপদেষ্টাদের অবস্থাও কি তাই? হাস্যকরই কেবল নয়, বিএনপির মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের নাজুক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থায় উদ্বিগ্নও। বিএনপির নেতারা যদি ‘সরল বিশ্বাসে’ বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরাফিকে গ্রহণ করে থাকেন, তবেও কথা থাকে; কারণ সারল্যেরও সীমা থাকে! দেশের রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সময়ে জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন অমনোযোগিতা অপ্রত্যাশিত।

মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরাফির পরিচয় নিয়ে নানা কথার সময়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তিকে ধরে এনে জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে তাকে দিয়ে সেখানে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে দিয়েছে, কথা বলেছে। পাশে আবার তাদের বড় বড় নেতারা বসেছিল। মার্কিন দূতাবাস বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সে সরকারের কেউ নয় এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবও বলেছেন এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। কিন্তু এখানে স্পষ্টত বিএনপি একটি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে’। মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘আমাদের কাছে যে খবর আছে, সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে ইসরায়েলের একজন এজেন্ট, এটি বিভিন্ন সূত্র বলছে। ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত কিছু বলেনি। এজন্য ইসরায়েল বিএনপির ওপর সন্তুষ্ট। অনেকে বলছে, একজন ইসরায়েলি এজেন্টকে তারা পাঠিয়েছে, যাকে নিয়ে কালকে (শনিবার) তারা সভা করেছে।’

তথ্যমন্ত্রী জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে সামনে আনা ব্যক্তিকে বিএনপির ‘জালিয়াতি’ বলছেন। তার এই বক্তব্যকে যদি আমরা স্রেফ রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে না দেখি, তবে এটা সত্য সত্যই জালিয়াতি, বড়ধরনের জালিয়াতি। এই জালিয়াতির মাধ্যমে বিএনপি কি সারাদেশে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, সরকারের আর বেশিদিন নেই, আগামী ৩ নভেম্বরেই সরকারের পতন হয়ে যাবে। এই জালিয়াতির মাধ্যমে কি বিএনপি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, আমেরিকার স্যাংশন আসছে?

জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে সামনে আনা ব্যক্তিকে দিয়ে বিএনপি কি তবে ২৮ অক্টোবরে রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে চাইল? মহাসমাবেশের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত এই বিশ্বাস ছিল যে ২৮ অক্টোবরেই সরকারের পতন হয়ে যাবে। বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সে উচ্চাশা নিয়েই ঢাকা গিয়েছিল, আগ্রাসী হয়েছিল। আর ফিরেছে ব্যর্থ হয়ে। এমন অবস্থায় তাদের হৃত বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কি এই জালিয়াতি করতে হলো তাদের?

আমরা এখনো জানি না, জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে সামনে আনা ব্যক্তিটির কী ছিল উদ্দেশ্য? মিথ্যা পরিচয়ে কেন তাকে গণমাধ্যমের সামনে এনেছিল বিএনপি? মিথ্যা পরিচয় প্রকাশ্য হয়ে যাওয়ার পর এখন কেন সবাই দায় নিতে চাইছে না? তবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনাহুত এই অনুপ্রবেশকারীর উদ্দেশ্য এবং তার সঙ্গীয়দের পরিচয় সামনে আনতে পারবে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তৃতীয় শক্তিকে সামনে আনার দুরভিসন্ধির এই সময়ে অনাহুতদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি এই পথ বন্ধের ব্যবস্থা করা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর