ভোট, নতুন সরকার ও বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়ন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-26 16:30:46

মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তিকে (নয়াদিল্লী, ১৬ মে ১৯৭৪) মূলভিত্তি হিসাবে নিয়ে, শেখ হাসিনা-মনমোহন সিং প্রটোকল চুক্তি (ঢাকা, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১) এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (ঢাকা,৭ জুন ২০১৫) বৈঠকে ছিটমহলের অধিবাসীদের ভাগ্যাকাশ সুপ্রসন্ন হয়। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং নরেন্দ্র মোদির অশেষ আন্তরিকতায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি (জনসংখ্যা ৩৮ হাজার ১৮১ জন, আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর) এবং ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীর (জনসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার জনমানুষ, আয়তন মোট ৭ হাজার ১১০ একর) প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারতের আইনসভার রাজ্যসভায় ৬ মে, ২০১৫ এবং লোকসভায় ৭ মে, ২০১৫ ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ার মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৬৮ বছরের (১৯৪৭-২০১৫) পরিচয়হীন, নাগরিকত্বহীন ও ঠিকানাবিহীন প্রায় ৫৪ হাজার অবরুদ্ধ মানুষের বন্দি জীবনযাত্রার অবসান ঘটে।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে (১২টা ১ মিনিট) অর্থাৎ ১ আগস্ট ২০১৫ সালের প্রথম প্রহরে জীবনে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার সুখ অনুভব করেছে স্বাধীন দেশে পরাধীন জীবনযাপনের স্বাদ নেওয়া রাষ্ট্রীয় অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো।

২. ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৫০ একর ভূমি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ প্রায় ১০ হাজার একর জমি বেশি পেলেও এ নিয়ে কোনো পক্ষের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা উক্ত জমি হারালেও শেখ হাসিনা-মনমোহন সিং স্বাক্ষরিত প্রটোকল চুক্তি (ঢাকা, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১) অনুযায়ী ভারত কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ পাবে না। আরো উল্লেখ থাকে যে, শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির ঐতিহাসিক বৈঠকে শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামে যাতায়াতের জন্য ভারতের ‘তিন বিঘা করিডোর’ ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। বিলুপ্ত ১১১টি ছিটমহলের অধিবাসীর মধ্যে এখন নির্বাচন ও ভোট উৎসবের আমেজ। সরকারি তথ্য মতে, বাংলাদেশে বিলুপ্ত ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে নীলফামারীতে ৪টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, এবং লালমনিরহাটে ৫৯টি ছিটমহল রয়েছে। ছিটমহলে বসবাসরত ৩৭ হাজার ২৬৯ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায় এবং তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় ২২ হাজার ভোটার। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া যেখানে ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ১৭২ জন। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর জীবনে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তারা।

৩. সুদীর্ঘ সময়কালের বঞ্চনার অবসানের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সুষম উন্নয়নের অংশীদার করার জন্য গত তিন বছরে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টা ও প্রত্যয় ছিল চোখে পড়ার মতো। পরিচয় ও ঠিকানাবিহীন মানুষের জীবনে স্বাধীনভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ায় এবং দ্রুত উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ায় শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে গৌরববোধ করেন তারা। তারা মনে করেন শেখ হাসিনা তাদেরকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন। একটি স্বাধীন দেশ, পতাকা ও পরিচয় পাওয়ার তৃপ্তির সাথে সাথে বিগত তিন বছরে মহাজোট সরকারের অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ননীতির ভিত্তিতে ছিটমহলগুলোতে বিদ্যুৎ, কৃষি ও মৎস্য; একটি বাড়ি একটি খামার; আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় বাসস্থান নির্মাণ; অতিদরিদ্রদের জন্য দৈনন্দিন কর্মসংস্থান কর্মসূচি; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ফাঁড়ি ও স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন; বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা; রেশন কার্ড প্রদান; কাগজপত্র প্রদানের মাধ্যমে ভূমি সংক্রান্ত নামজারি; পোস্ট অফিস, ডিজিটাল তথ্যসেবাকেন্দ্র ও কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন; ব্রিজ, কালভার্ট ও কাঁচা-পাকা রাস্তার যোগাযোগ ব্যবস্থা; সরকারি প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা এবং কলেজে পড়ার সুযোগ; সুদৃশ্য শহীদ মিনার তৈরি; হতদরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য বিনামূল্যে সেলাই মেশিন প্রদান; বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও সুপেয় পানীয় জলের জন্য নলকূপ স্থাপন এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড প্রদান; হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রণয়ন; মসজিদ-মন্দির স্থাপন; ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠা; ইন্টারনেট সংযোগ; ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমুখী উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে।

৪. তাছাড়া জমিগুলো চাষাবাদের জন্য সেচের আওতায় আনতে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সৌর বিদ্যুতচালিত গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে এবং কৃষি অধিদপ্তরের সহায়তায় বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে কৃষি যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে । ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তবে বড় দু:খজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছায় ভারত গমন করা প্রায় ১০০০ মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব, দুই কক্ষবিশিষ্ট টিনসেডের বাসস্থান এবং রেশন কার্ড ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পায়নি। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে তারা। এ প্রসঙ্গে গত ১০ জুন, ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল যে দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে, ছিটমহলে বসবাসকারী জনগণ স্থানান্তরের মাধ্যমে তারা সেই দেশের নাগরিক হবেন। তবে ইচ্ছা করলে তাদের পূর্ববর্তী দেশের নাগরিক হওয়ারও সুযোগ থাকবে।

৫. বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলেও ৩০ ডিসেম্বর একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জীবনে প্রথম সরাসরি ভোট প্রদান করে দেশের সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে অত্যন্ত খুশি বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিবাসীরা। দীর্ঘদিন এক ধরণের বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো গত তিন বছরের উন্নয়ন দেখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন নতুন করে। ১৯৪৭ সালের যুবকদের অনেকেই আজ নেই। যারা আছেন তারা সকলেই প্রবীণ। বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রবীণ জনগোষ্ঠী জীবনের শেষ বেলায় প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এলাকার টেকসই উন্নয়ন দেখে যেতে চান তারা। ১৯৭১ সালের স্বপ্নবাজ তরুণেরা নিজেদের জন্য না হলেও পরিবার, এলাকার সন্তানদের নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা দল বেঁধে স্কুল-কলেজে যাবে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈমানিক, বিসিএস কর্মকর্তা, সফল ব্যবসায়ী হবে! আর কখনো নাগরিকত্ব না থাকার কারণে চিকিৎসাসেবা নেওয়া বন্ধ হবে না! এলাকাভেদে কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা ৫০-১০০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল তাদের আশেপাশে থাকবে! এমন একটা সময় তারা পার করেছেন যখন পরিচয় ছিল না, দেশ ছিল না, ছিল না নাগরিকত্ব। পালিয়ে লেখাপড়া কেউ করতে পারলেও অনেকেই পারেননি। অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সুনির্দিষ্ট পরিচয়ের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারেননি।

নিজ এলাকার অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাই নতুন সরকারের কাছে অনেক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে প্রতীক্ষায় রয়েছেন এই এলাকার আপামর জনগোষ্ঠী। সুদীর্ঘ সময় লেখাপড়া করতে না পারা ছিটমহলবাসী চাকরির ক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য ‘বিশেষ কোটা’ ব্যবস্থা প্রবর্তন প্রত্যাশা করেন। তারা নির্বাচিত প্রার্থীদের কাছে ছিটমহলের উন্নয়ন এবং মাদকদ্রব্য নির্মূলে ভূমিকা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, এলাকায় ক্ষেত্রবিশেষে কাঁচা-পাকা রাস্তা, পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা; কৃষি ও মৎস্য খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি মহাজোট সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শতভাগ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করেন। তাদের প্রত্যাশা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধে ভোট প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠনে সহায়তা করা, যে সরকার বিগত সরকারের মতো বিভিন্ন ধরণের অব্যাহত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি ছিটমহলের পরতে পরতে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌছে দেবে।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর