বিদেশ নির্ভরতা রাজনীতিকে কি দিল?

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2023-11-15 22:38:29

ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের সংস্কৃতি এই অঞ্চলে নতুন নয়-তা আমরা সবাই জানি। দুর্দণ্ড প্রতাপের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক থেকে নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের শামরিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরতে পরতে আন্দোলন-সংগ্রামই ছিল বাঙালির মজ্জাগত এক প্রবৃত্তি। কেবল বলা হয়ে থাকে তাই নয়, ইতিহাসের ধ্রুব সত্য হচ্ছে, ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা ও পাঞ্জাবকে ঔপনিবেশিক শাসকরা বিভক্ত করার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখে এই দুটি প্রদেশের অধিবাসীদের অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠার অপরিসীম শক্তির ঐশ্বর্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক যে ইতিহাস আমাদের সামনে রয়েছে, তার মোটামুটি চিত্রটি উল্টে-পাল্টে দেখলে যেটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে, ঐতিহাসিক পরম্পরা অক্ষুন্ন রেখে বাঙালিরা শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সিদ্ধহস্ত। পূর্বাপর ইতিহাস টানতে গেলে, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই, ছিয়ানব্বই-এমন অনেকগুলো সাল টানা যাবে, যে সময়গুলোতে বাঙালির প্রতিবাদী সত্ত্বা বার বার জ্বলে উঠেছে। বঞ্চনা ও অসন্তোষের মুখে উর্দিধারী সামরিক শাসকদের বিদায় করার সাফল্য রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রতিবাদী জনতার। এবং উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, সেই সকল ঐতিহাসিক আন্দোলনের কিংবদন্তিরা আজও জীবিত ও তারা দেশের প্রধান দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ নেতা।

প্রসঙ্গ হচ্ছে-আজ (১৫ নভেম্বর ২০২৩) সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি রোববার এই ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিএনপি পূর্বঘোষণা দিয়ে একটি সমাবেশ আয়োজন করে। যদিও সহিংসতার ঘটনায় শেষ অবধি সমাবেশটি পণ্ড হয়ে যায়। এর পর বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করে। দলগুলির অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই বুধবার আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-যে সমস্ত দাবি আদায়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অনেক দিন থেকেই সরব রয়েছেন, সেখানে ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের নূন্যতম সাড়া মেলেনি কেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দাবি আদায়ে বিএনপি বা সমমনা দলগুলো তাদের আন্দোলনকে ততোটা তীব্র করে তুলতে পারেননি, যতোটা তীব্র হলে একটি শক্তিশালী সরকারকে হটানো যায়। আমরা সাম্প্রতিক দশকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে যদি তাকাই তবে স্পষ্টতঃই বিএনপি’র এই সময়ের আন্দোলন কর্মসূচির দুর্বলতার দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

বিএনপি’র সাবেক ও সদ্যসাবেক অনেক নেতাকেই আমরা বলতে শুনেছি, তৃণমূলে এত জনসমর্থন থাকার পরেও দলটি মূলতঃ নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং ঠিক সময়ে ঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে না পারার খেসারতই গুণছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি’র বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের সিংহভাগই বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ার কারণে মাঠের আন্দোলনকে ততোটা প্রাধান্য দেননি।

আমরা গত দু’দিন দেখতে পেলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অফ স্টেটের চিঠিতে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নানের আলোচিত সেই সংলাপের কি ফলাফল! আপাতদৃষ্টিতে এমন কোন কারণ ঘটেনি যার জন্য আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপে বসে দেশ ও জাতির জন্য একটি সুখকর খবর দেবেন।

ঔপনিবেশিক যুগে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বরপুত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর একটি বিখ্যাত উক্তি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘ফ্রিডম ইজ নট গিবেন, ইট ইজ টেকেন’ মানে স্বাধীনতা এমনিতেই আসে না তাকে ছিনিয়ে নিতে হয়। অবস্থাদৃষ্টে এটি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যায়, দাবি ছিনিয়ে নেওয়ার মত অবস্থায় বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের আন্দোলন-কর্মসূচিকে প্রবাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করলাম, সদ্য দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘টু প্লাস টু’ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠককে ঘিরে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গে মিত্র দুটি দেশের একটি অভিন্ন অবস্থানে পৌছানোর জল্পনা বেশ তুঙ্গেই উঠেছিল। কিন্তু আমরা কি দেখলাম? ভারত তার চিরবন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি অভ্যন্তরীন ইস্যু বলেই উল্লেখ করে তাতে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের প্রকাশ্য সমর্থন না জানালেও পরোক্ষভাবে বিষয়টি সরকারের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিতবহ বলেই বর্ণনা করছেন রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত কয়েক দিন আমরা মার্কিন আধিপত্যকে স্বীকার করা কিছু সংস্থার ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ ইস্যুতে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি। ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাসের একক দৌঁড়ঝাপ ছাড়া বিশ্বের অন্যদেশ কিংবা তাদের কুটনীতিকদের চোখে পড়ার মত তৎপরতা আমরা এখনও দেখিনি। তার মানে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের অপরাপর দেশগুলি এবিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন? কিংবা মৌনতার কৌশল নিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছেন?

এসব সদুত্তর খুঁজতে যাওয়ার পূর্বে আমরা যদি আরও গভীরে দেখবার চেষ্টা করি, তবে এর সঙ্গে কিছু যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে বৈকি! ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ সাম্প্রতিক সপ্তাহ ও মাসগুলিতে তাদের যে মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলতঃ তিন পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সতর্ক দৃষ্টি এবং নীতিগত অবস্থান রয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। এটি যে এমনি এমনি তা কিন্তু নয়। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেই দেশগুলো বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের এই অবস্থান জানান দিয়ে আসছেন। পরাশক্তি রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিমাত্রিক স্বার্থদ্বন্ধের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক ও কৌশলগত গুরুত্বের বিষয়টি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এমন বাস্তবতায় বিএনপি বা সমমনা দলগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতার ফল যে চূড়ান্ত লক্ষ্যে জয়যুক্ত হতে না-ও পারে সেই ধারণায় দলটির শীর্ষনেতাদের বড় ভ্রান্তিকেই দায়ী করছেন অনেকে।

কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির এমন ব্যর্থতাই কি ক্ষমতাসীনদের তথাকথিত ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ ত্বরান্নিত করবে? এমন ধারণাকেও যুক্তিযুক্ত নয় বলে মত অনেক বিশ্লেষকদের। তাদের মূল্যায়ন সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি সত্ত্বেও সাধারণ-প্রান্তিক মানুষদের কাছে সরকারকে মূল্যায়নের আরও মানদণ্ড রয়েছে। চলমান বৈশ্বিক মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ অর্থনীতে যে ধাক্কা দিয়েছে তার ঢেউ অনেক আগেই আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে। কিন্তু ধর্তব্যের বিষয় হচ্ছে, অভ্যন্তরীনভাবে যে সক্রিয়তা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে সাধারণ মানুষ এ অবস্থার মাঝেও খানিকটা স্বস্তি পেতে পারতো সরকার তা করতে নিদারুণভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতিতে সাধারণের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সুশাসন ও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপর্যয়ের ধাক্কায় জনমানুষের মনে বিক্ষোভ ক্রমেই ফেনায়িত হচ্ছে বলেই আমরা গণমাধ্যমের খবরে দেখতে পাচ্ছি। অপরদিকে, ক্ষমতাসীন দল, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাদের প্রতিও সাধারণের অসন্তোষ বেশ জোরেসোরেই উচ্চারিত হয়। এছাড়া তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে সর্বত্র অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের অন্দরের কৌমার্য প্রায়শঃই প্রকাশ পায়। এসব সত্ত্বেও উত্তম বিকল্প প্রকট হয়ে না উঠার ফলে সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং তা জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রান্তেও সাফল্যের মুখ দেখেনি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর