ওই জিনিসটাই নেই- সেটা নৈতিক মূল্যবোধ!

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-12-06 15:45:19

সেদিন একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তাদের বিতর্ক শুনে সবাই অনেকটা বিমোহিত। আমিও কিছুটা অবাক হয়েছি উভয় দলের তার্কিকদের ভাষা ও বচনভঙ্গি শুনে। বিতর্ক শেষে নির্বাচিত আলোচকবৃন্দ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির উপর বক্তব্য দিলেন। দশ-বারটি সুপারিশ উঠে এলো। কিন্তু একজন ক্ষুদে বক্তা কিছু সময়য়ের জন্য তাকে বিতর্কের বাইরে আরো কিছু বলার সুযোগ দিতে অনুরোধ করলো। সেটা শুনে উপস্থিত সবার চোখেমুখে ভিন্নকিছুর আভাস ফুটে উঠলো।

তার্কিক বললো, সবার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সবারটা মানতে চেয়েও পারছি না। কারণ, সবাই একটি কথা বলতে গিয়েও অস্পষ্টভাবে বলছেন কেন তা বোধগম্য নয়। এই অস্পষ্টতার আড়ালে যেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে তা হলোওই জিনিসটা। আর ওই জিনিসটার বড় আকাল লেগেছে। শুনতে চান আপনারা- ওই জিনিসটা কি? আমাদের মধ্যে ওই জিনিসটাই নেই- সেটা ওপেন সিক্রেট, সবার জানা গোপন কথা। তা হলো সততা-নৈতিকতা! ওর সুস্পষ্ট কথায় বলিষ্ঠ সুর শুনে সবাই ভিমড়ি খাবার যোগাড়।

এবার তার বক্তব্য আরো বেগবান হলে সে গড় গড় করে বলতে লাগলো- আমরা ছোট মানুষ। আমাদেরকে গণমাধ্যমে কেন বিতর্কের নামে বড়দের ঝগড়া, খারাপ কথা শুনতে হয়? বর্তমানে দেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে যে বাকযুদ্ধ ও শক্তিপ্রয়োগের মহড়া শুরু হয়েছে তার মূল কারণ হলো- ‘নিশীথের ভোট’যেটা বহুবার বহু জায়গায় বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে, ছাপা হয়েছে। এমনকি এজন্য দেশ ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতেও তোলপাড় হয়েছে। মামলা-হামলা হয়েছে, কারাবরণ হয়েছে এবং সেগুলো চলছে। কিন্তু সেই কারণগুলোর তদন্ত হয়নি, নিষ্পত্তি হয়নি। এখন ভাবনা হচ্ছে, ‘আমি আছি থাকবো, যেভাবেই হোক নির্বাচন হবে।’এজন্য ‘নিজের পরীক্ষায় নিজে নিয়ন্ত্রক হবার অপবাদ ও  গ্লানিটুকুও কাউকে স্পর্শ করে না। ফলত: সেগুলোর পৌণ:পুনিক আশঙ্কা থেকেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে আয়োজনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা জটিলতা তৈরী হয়েছে।’

সেদিন একটি বৃহৎ মহাসমাবেশ ভন্ডুল করার উদাহরণ দিয়ে সে বলতে চেষ্টা করলো- ‘এতবড় জনসমাবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে আয়োজনের ঘাটতি ছিল না। মহাসমাবেশ শেষ না হতে মাঝপথে হঠাৎ বিকট সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ে কেন আতঙ্ক তৈরী করা হয়েছিল? সমস্যা সেখান থেকেই নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হয়। সেই শব্দ ও গ্যাস ছোঁড়া না হয়ে জনসভাটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবার সুযোগ পেত এবং সেখানে কোনরুপ গোলযোগ হতো না। একজন নিরীহ পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। হাজারো গ্রেনেড, গুলি, গ্যাস শেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার কি দরকার ছিল?’

‘সেদিন নিযুক্ত হাজার হাজার নিরাপত্তাকর্মীর মধ্যে রহস্যজনকভাবে একজন সদস্যকে রেখে অন্য নিরাপত্তা সদস্যরা সবাই কেন দৌড়ে পালিয়ে গেলেন তাও বোধগম্য নয়। টিভিতে দেখা গেছে মোটামুটি ফাঁকা রাস্তার ফুটপাতে কতিপয় উচ্ছৃংখল জনতা তাকে পেটাচ্ছিল। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্বেও কেন তারা মাত্র একজন সহকর্মীকে ফেলে রেখে সবাই উধাও হয়ে গেলেন- সেসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এমনকি সেই সদস্যের আহত হয়ে দীর্ঘক্ষণ রাজপথে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তড়িৎ কোন এম্বুলেন্সও আসেনি তাঁকে উদ্ধার করতে। এরপরের ঘটনা তো আপনারা সবাই বেশ কদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছেন। সেগুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’

তার দলের আরেক সদস্য তাকে সাপ্লিমেন্ট করার সুযোগ চেয়ে বলতে লাগলো- তবে এসব দেখে মনে হয় দেশের অর্থনীতির বড় ধরণের ক্ষতি করার জন্য এই হীন পরিকল্পনা অত্যন্ত সুকৌশলে সাজানো হয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনের ঘটনার ১২ দিন পর জানানো হচ্ছে- প্রতিদিন অবরোধে দেশের ৬.২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এর মূল কারণ রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মহাসমাবেশে আতঙ্ক তৈরী করে ‘মব’বা উচ্ছৃংখলতা সৃষ্টি করা। দেশে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান কখনই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।’

গেল অক্টোবরে ঢাকার কাওলায় এবং ১১ নভেম্বর ২০২৩ মাতারবাড়ির জনসভায় শোনা গেছে- ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন এদেশে হবে।’গণমাধ্যমের কল্যাণে ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন’নিয়ে উৎসাহ বেড়েছে। দ্য গার্ডিয়ান (১০.১১.২০২৩) এটাকে ‘প্রি ইলেকশান ব্রুটাল রিপ্রেশন... দেয়ার আর নো মোর রুম লেফ্ট ইন দা প্রিজনস’বলেছে। দেশ-বিদেশ ভেদে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সবার চাওয়া। মূল কথা হলো- জনগণ নির্বাচন চায়, কিন্তু যেনতেন নির্বাচন চায় না।’

‘এই অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে জনাতঙ্ক ও ভয়ংকর ভীতি সৃষ্টির দায়টা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু এ ধরণের জনভোগান্তিমূলক অন্যায় কাজের জন্য রাষ্ট্র সবসময় তাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকে।

অপরদিকে আগামী নির্বাচনের এখনও তপসিল ঘোষিত হয়নি অথচ রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য আয়োজিত নানা জনসভায় ক্ষমতাসীন দল একাই সাড়ম্বরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় যানবাহন ব্যবহার করে অফিসিয়াল কাজের জন্য নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে তপসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনের জন্য নিজের মার্কায় জোরগলায় ভোট চাওয়া নিশ্চয়ই ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। নতজানু পরাধীন নির্বাচন কমিশন এখানে কিছুই বলার ক্ষমতা রাখেন না। এখানে কারুরই ওই জিনিসটা নেই। তাহলো- নৈতিকতা।’এথেকে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যা বুঝি তা স্বাথর্পরতা শেখাচ্ছে।

এভাবে দ্বিতীয় তার্কিকের বক্তব্য শুনতে শুনতে উপস্থিত সবাই খানিকটা চুপ হয়ে গেল। সেদিন কেউ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো না।

বিষয়টা হলো একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চ্চার পথে যেসব কন্টক ওঁৎপেতে থেকে জনগণের কন্ঠকে রোধ করতে সহায়তা করছে তার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল বিভিন্ন শাখা বহুলাংশে দায়ী। সেসব দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হীন ভূমিকা আজকাল বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা নিজস্ব পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে দলীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি শুরু করে দিয়েছে। এদের অনেকের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিঁটেফোটাও নেই। এদের অনেকের ছাত্রজীবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়- তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হীন ছাত্ররাজনীতি করতো এবং হলের ডাইনিংরুমে ‘ফাও’খাওয়া দলের সদস্য ছিল। অনেকে ‘কালো বিড়াল’পদ্ধতিতে চাকুরী জুটিয়ে নেবার পর দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়াতো। এসব ‘বানরের গলে মুকুতার হার’জোটায় তারা দেশের কল্যাণের কথা মোটেও চিন্তা করে না। তারা অনেকই পরিবার দেশের বাইরে রাখা দ্বৈত নাগরিক। অথবা দেশের আপামর মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করার অর্ন্তর্নিহিত শক্তি তাদের মধ্যে নেই।

তাইতো আমাদের দেশের অদূরদর্শী, ব্যবসায়ী, লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের ফাঁদে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরো দীর্ঘায়িত করে তুলেছে। এউ উভয়বিধ শক্তি একসংগে মিলিত হয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেবার নীলনক্সা তৈরী করেছে। এই নীলনক্সার ফাঁদে এখন বাংলাদেশের অসম উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও চরমভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ শ্রমিকদের কর্মহীনতা ও কর্মঅসন্তোয় শুরু হয়েছে। কারণ, শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনলেই উন্নতি হয় না। সেই গাড়িতে চড়ার মতো ও গাড়ি মেইনটেইন করার মতো ও উপযুক্ত মানুষ তৈরী করতে হয়। যার ইতিবাচক প্রচেষ্টা নেই আমাদের দেশে। অগণতান্ত্রিক কূটকৌশলে দেশের ৭৫-৮০ ভাগ মানুষকে সেই সুবিধার বাইরে রেখে চলার চেষ্টার ফলে যে সামাজিক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা রুখে দেবার মত সামাজিক শক্তি রাষ্ট্রের হাতে কোন দেশে কস্মিন কালেও ছিল না। বরং ইতিহাসে সেসব দেশে গণবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়ে ভয়ংকর নাজুক পরিস্থিতিতে গণেশ উল্টে যেতে দেখা গেছে।

তাদের হীন পরিকল্পনার জন্য জনগণ শুধু বিব্রতই নয়- বড় নাজেহাল হয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব হীনতা, দীনতা, নিচতা শুধু বইয়ের কথা নয়। এগুলোর সংগে চরম বাস্তবতা জড়িত। এই বাস্তবতাকে যারা দু’একবার অস্বীকার করে এবং সঠিক পথে ফিরে আসে তারা রক্ষা পায়। আর যারা ক্রমাগত এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আরো এগিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলতে চায় তারা চরমভাবে হোঁচট খায় ও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। যুগে যুগে এটাই সঠিক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

আলোচ্য বিতর্ক অনুষ্ঠানের কিশোর তার্কিকদের মুখ থেকে উচ্চারিত বক্তব্য সেদিন উপস্থিত সদস্যরা এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে যারা পরবর্তীতেও শুনেছেন তাদের কপালের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা চিন্তার বলিরেখা ভেসে উঠেছে। আমাদের দেশে চারদিকে অনৈতকতার চর্চ্চা এবং এর প্রভাবে যেসব অনাচার, দুর্নীতি, অসততা ও জনভোগান্তির ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অতি সহজ ব্যাপার নয়।

তাই সেই কিশোর তার্কিকদের মতো মনে রাখতে হবে, আপনি যাই বলুন না কেন- যাই করুন না কেন সেখানে সবার আগে অপরের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না সবাইকে সেটি মনে রাখা। কারণ, আমরা এমন একটি সমাজের মধ্যে বাস করছি সেখানে মুখের কথায় সবার সবকিছু আছে বলে ফুলঝুরি তোলা হলেও অনেক দায়িত্বশীল মহারথীদেরও শুধু ‘ওই জিনিসটাই থাকে না, তা হলো-  নৈতিক মূল্যবোধ।’

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর