খালেদা-তারেকের ভুলেই বিএনপির এই করুণ পরিণতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-26 00:10:24

না, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলে তেমন কোনো ‘চমক’নেই। আওয়ামী লীগসহ মিত্ররা যেমনটি আশা করেছিল, তার চেয়ে ‘ভালো’ ফল তারা পেয়েছে। পক্ষান্তরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক ‘খারাপ’ফল পেয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বগুড়ায় বেগম খালেদা জিয়ার আসনে জয়ী হয়েছেন বটে। এর বাইরে ঐক্যফ্রন্টের কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাই জিততে পারেননি। ‘অনিয়ম ও কারচুপি’র অভিযোগে জামায়াতসহ অনেকেই নির্বাচন থেকে আগেভাগেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

এদিকে আওয়ামী ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ‘ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণ’ভাবে হয়েছে বলে দাবি করা হলেও নির্বাচনী সহিংসতায় সারা দেশে অন্তত ১৭ জনের নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। এতে বোঝা যায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরা একেবারে নিষ্ক্রীয় ছিলেন না। যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানে তারা ঠিকই শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে। যদিও সেই ‘শক্তি প্রদর্শন’ কোনো কাজে আসেনি। দলের বিপর্যয় ঠেকাতে সেটা কোনো রকম ভূমিকাই পালন করতে পারেনি।

নির্বাচন শেষে রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনঃভোটের দাবি তুলেছেন। তিনি নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।

ঐক্যফ্রন্টের এই দাবি ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ বলেই মনে করছে। দেশের গণমাধ্যমগুলোও এই নির্বাচন নিয়ে তেমন বড় কোনো অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেনি। কোনো কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষকও নির্বাচনকে ‘ভালো’বলেই রায় দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন ‘কিছু অনিয়মসহ’মোটামুটি ভালো নির্বাচন হিসেবেই পরিচিতি পাবে বলে ধরে নেয়া যায়।

এই নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ছিল না, ক্ষমতাসীনরা জেতার জন্য নানা ‘কারসাজি’করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটকে ‘হারিয়ে দিয়েছেন’- একথা যেমন ঠিক, একই সঙ্গে এই ভরাডুবির জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও কম দায়ী নয়। তারা এবারের নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাবই সৃষ্টি করতে পারেনি। ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে-একথা যেমন ঠিক, পাশাপাশি তারা অনেক ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারেনি-একথাও তো মিথ্যে নয়। একশ ত্রিশটি আসনে ঐক্যফ্রন্ট বা ধানের শীষের প্রার্থীর কোনো তৎপরতাই ছিল না। আওয়ামী লীগের মতো একটি সুসংগটিত একটি দলের বিপরীতে এভাবে নির্বাচন জেতার আশা বাতুলতা মাত্র!

নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করার পাশাপাশি নিজেদের ত্রুটি-দুর্বলতাগুলোও খুঁজে বের করা দরকার। ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকেই নিজেদের অতীত কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করা দরকার। দল হিসেবে বিএনপির উপযোগিতা শেষ হয়ে গেছে কি-না-সেটাও মূল্যায়ন করে দেখতে হবে।

বিএনপি দেশের বড় দলগুলোর একটি। সামরিক শাসনের মধ্যে সামরিক শক্তির জোরে ক্ষমতায় এসে সেনাশাসক জিয়া যে দল করেছিলেন, সেই দল ৪০ বছরের জীবনে প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। ১০ বছর ছিল সংসদে প্রধান বিরোধী দলে। কয়েকদিন আগে তারা ঘোষণা দিয়েছিল, বিএনপি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য ৪০ হাজার কমিটি করবে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি।

একটা পলায়নপর মানসিকতা লক্ষ করা গেছে শুরু থেকেই। পুলিশ-প্রশাসন বিএনপির প্রতি নির্দয় এবং অন্যায় আচরণ করেছে। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা এর প্রতিবাদে কখনই সোচ্চার হতে পারেনি। সরকার একতরফা এবং বাধা-বিঘ্ন-প্রতিবাদহীনভাবে বিএনপি দলনের কাজটি করে গেছে। যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিএনপি নেতা তারেক রহমান গ্রেনেড মেরে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছেন, যে বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ তিন মাস পেট্রোল-বোমা হামলা করে গোটা দেশকে নরক বানিয়ে ফেলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন, সেই বিএনপিকে বাগে পেয়ে তারা যে চেপে ধরবে-এটা সঙ্গত না হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীরা কখনও মাঠে নামেনি। নেতারাও মাঠে নামার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি।

সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, প্রচলিত বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। যে কোনো গণতান্ত্রিক দলের উচিত, তাদের বাদ দিয়ে দল পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু বিএনপি সে পথে হাঁটেনি। তারা চেষ্টা করেছে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানকে আগলে রাখতে। বহু বিতর্কের নায়ক তারেক রহমান দলের মনোনয়প্রত্যাশীদের বিভিন্ন ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপস ব্যবহার করে অনলাইনে সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। এটা বিএনপির পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে একটা নৈতিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা। যে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন হারিয়েছে, দলের শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে, সেই দলের নেতাদের ধানের শীষে মনোনয়ন দিয়ে বিএনপি সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা করেছে। মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিকারী ব্যক্তি ও দলকে জোটে রেখে, নিজেদের দলীয় প্রতীক তুলে দিয়ে বিএনপি সর্বশেষ আস্থার আসনটি ফেলেছে।

এবারের নির্বাচনের শুরু থেকেই বিএনপি ছিল উদভ্রান্ত। ভালো প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া, সঠিক সময়ে নির্বাচনের প্রচার শুরু করা, জামায়াত প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা কর্মী-সমর্থকরা পর্যন্ত দলটির আস্থাভাজন ছিল না।

একটু ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে যায় শুধুমাত্র একটি ভুল পদক্ষেপ। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বার বার তেমন ভুলই করেছেন। একটু যদি পেছনে ফিরে তাকালে এবারের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির কারণ বুঝতে সুবিধে হবে। এবারে বিএনপির ভরাডুবির মূলে রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারস বেগম খালেদা জিয়ার অতীত কর্মকাণ্ড।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি প্রথম যে ভুলটা করলেন তা হল ১৯৯৬ সালে বিরোধীদের (আওয়ামী লীগ ও জামায়াত জোট) দাবিকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রথমে অপছন্দ করে। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি তথাকথিত (৫ই জানুয়ারির অনুরুপ) নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। শেষপর্যন্ত আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেন। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা আসেন।

শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতাসীন অবস্থায় (১৯৯৬-২০০১) অত্যন্ত সুন্দরভাবে নেতৃত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনি কোনো ধরনের দুরভিসন্ধির আশ্রয় নেননি (২/১ টা ভুল ছাড়া), সুন্দরভাবে কোনো চতুরতা ছাড়াই ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং নির্বাচনে পরাজিত হন।

খালেদা জিয়ার ভুলটা ছিল ২০০৬ সাথে ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়াটা; বিভিন্নভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরবর্তী প্রধানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা (বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো), অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের মতো ‘একজন মেরুদণ্ডহীন’কে নীতিবিরুদ্ধ পন্থায় প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া এবং আজিজের মতো আরেকজন ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা ইত্যাদি। ইয়াজউদ্দিনের সরকারকে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা এবং ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে একটি নীল-নকসার নির্বাচনের চেষ্টা করা।

বেগম খালেদা জিয়ার এটা ছিল একটা মস্ত ভুল। টানা ৫ বছর দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান বুঝতে পেরেছিলেন- তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না; এবং এজন্যই চতুরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেয়ার ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করে। এই হামলা খালেদা-তারেক ও বিএনপির প্রতি শেখ হাসিনাকে কঠোর হতে বাধ্য করে।
যা হোক, মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হল ২০০৯ সালে অধিকাংশ ভোটারই বিএনপি-জামায়াতের উপর বিরক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নৌকায় ভোট প্রদান করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। ঘটনাটা এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু ততদিনে বিষয়টা সত্যি সত্যিই বেগম খালেদা জিয়ার ভুলে তিক্ততায় রূপ নেয়। এবং শেখ হাসিনা তার প্রথম দফা ক্ষমতাসীন থাকাকালে একটা চমৎকার সরকার উপহার দিলেও এই দফায় খালেদা জিয়ার নেতিবাচক উদ্যোগগুলো তাঁর মাথায় ঢুকে যায়। তিনি সতর্ক হয়ে যান। সেনাপ্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে দেশে আসতে বাধা দেয়, তাকে আটক করে জেলে রাখে। কিন্তু শেখ হাসিনা জেল খাটার মতো কোনো অপরাধ করেননি। প্রথম দফা ক্ষমতায় থাকা কালেও না, বিরোধী দল হিসেবে তো নয়ই। তাই তাঁর জেদ চেপে বসে। বেগম খালেদা জিয়ার দেখানো পথে হাঁটা শুরু করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বুঝতে পারে- ১৯৯৬-২০০১ টার্মে ভালো থেকে তো কোনো লাভ হলো না; কাজেই আর ভালো থেকে লাভ কি? তিনি ১৮০ ডিগ্রি ইউটার্ন নেন। এদেশের কিছু মানুষ তাঁর পিতার মৃত্যুতে আনন্দ-উল্লাস করেছিল; সেই ক্ষোভ তো ছিলই, সঙ্গে যোগ হয় ২১ আগস্ট তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও। তাই তিনি ‘বুলডোজার’চালিয়ে দেশ শাসনের নীতি গ্রহণ করেন। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। আইন এবং আদালতকে ব্যবহার করেই তিনি তা করেছেন।

শেখ হাসিনা স্পষ্টই বুঝেছেন, তিনি ভদ্রভাবে দেশ চালালে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না; এখন যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়- আবার মন্দের ভালো হিসাবে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। আর তাহলে ২০০১ সালের মতো আবারও আওয়ামী লীগকে কচুকাটা করা হবে। কাজেই কেন তিনি সেই ‘ভুল’করবেন?

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা তেমন ‘ভুল’আর করেননি। করেননি বলেই এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের এমন ত্রিশঙ্কু দশা! কাজেই নির্বাচনের এই হতাশাব্যঞ্জক ফলে কেবল শেখ হাসিনাকে দায়ী করলেই হবে না। বিএনপিকে নিজেদের অতীতকেও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য প্রয়োজনে ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হলে দোষারোপের পালাতেই কেটে যাবে অনন্ত কাল!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর