একটি কঠিন গণরায়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-22 13:57:00

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী মহাজোট ২৮৮ (যার মধ্যে এককভাবে আওয়ামী লীগ ২৬৬, জাতীয় পার্টি ২২টি) এবং বিএনপি জোট ০৭টি আসন লাভের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের সরকারের স্পষ্ট চিত্রটা সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং সাড়া দেশে নির্বাচনী সহিংসতায় ১৬ জন ব্যক্তির প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হল নির্বাচন। কোনো প্রাণহানিই কখনও কাঙ্ক্ষিত নয়, তারপরও অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এবারের নির্বাচনে সার্বিকভাবে সহিংসতার মাত্রা ছিল অনেক কম।

নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো কোনো মহলের অসন্তোষ থাকলেও দেশী বিদেশী পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে এটি সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় একে ছুড়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় একদিকে যেমন প্রত্যাশিত বলা যায় অন্যদিকে এই নির্বাচনের ফলাফল গণতন্ত্রপ্রেমী অনেক মানুষকে হতাশ করে থাকতে পারে। এই হতাশার কারণ অবশ্যই আসন্ন সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না পাবার হতাশা।

সার্বিকভাবে এই নির্বাচন নিয়ে নানা প্রকার বিশ্লেষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং নিশ্চিতভাবে এই ধারা আরও কিছুদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তবে এই বিশ্লেষণকে যদি নির্বাচনকে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন না করার মধ্য দিয়ে আমরা অব্যাহত রাখতে পারি তাহলেই কেবল একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করতে পারি। কারণ ক্রমাগতভাবে অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আজ আমাদের বিরোধী দলকে এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যা আমরা কখনও চাইনি।

বাংলাদেশে এর আগের দশটি নির্বাচনের কোনটিতেই আমরা দেখিনি বা শুনিনি যে নির্বাচনের ফলাফলকে পরাজিত দলগুলো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে বিজয়ী দলকে অভিনন্দিত করেছে। এবারের নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন সকালে এবং দূপুর পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন এবং বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানালেও সন্ধ্যার পর থেকে যখন একটি একটি করে নির্বাচনের ফলাফল আসতে শরু করে তখন ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে বসে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা এই নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে এর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুননির্বাচন দাবী করেন। এর আগের নির্বাচনগুলতেও আমরা একই চিত্র দেখেছি এবং পরবর্তী সময়ে পরাজিত দলগুলো তাদের প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

পরাজয়কে গ্রহণ করে আত্মসমালোচনার সংস্কৃতি না থাকার ফলে পরাজিত দলগুললোর ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করে বিজয়ী দলগুলোর সরকারে থাকাকালীন সময়ে বড় ছোট নানা ভুলের সমীকরণে। বলা চলে গত ১০ বছর সময়ের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের কিছু ভুল বা ব্যর্থতা থাকলেও তার তুলনায় রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে ব্যর্থতা এবং একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে নিষ্পত্তি করে দিয়েছে।

আমি আবারও বলব এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দল হিসেবে ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট এবং অপরাপর সকল নিবন্ধিত দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আবহ সৃষ্টি হলেও বাস্তবিক অর্থে ঐক্যফ্রন্টের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়নি। ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবর্গ নির্বাচনে ভোটবিপ্লব হবে বলে ভবিষদ্ববাণী করলেও ভোটের প্রতিবিপ্লব একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে রীতিমত জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এমন অবস্থায় তাদের এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের কোনো সুযোগ নেই, বরং রীতিমত জনগণের সামনে জবাবদিহিতার পর্যায়ে এসে তারা দাঁড়িয়েছে।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় এবং বিএনপির লজ্জাজনক পরিণতি আমাদের সামনে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেছে। এই নির্বাচনের ফলাফল সবচেয়ে বড় যে দিকটি তুলে ধরেছে তা সরকারি দলের কিছু মৌলিক ব্যর্থতা এবং ভুল সিদ্ধান্ত জনগণকে বিরোধী দলের প্রতি আস্থাশীল হতে প্ররোচিত করে। আমাদের বুঝতে হবে যে সরকারে যারা থাকেন তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গায় অবিচল থাকতে হবে এবং জনগণের সামনে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে আমাদের রাষ্ট্রে পরিচালনায় কিছু মৌলিক বিষয়ের সাথে আপোস করা চলবে না।

উপরোক্ত অবস্থার আলোকে আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১০ বছর সময়ের রাষ্ট্র পরিচালনায় লক্ষ্য করেছি দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়নে, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সম্মানজনক অবস্থান, এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে যুদ্ধপরাধ, মৌলবাদ, উগ্রবাদ এবং জঙ্গীবাদের বিপরীতে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের মিছিলে সামিল হওয়া। এই সব কিছুর বিপরীতে দীর্ঘ ১০ বছর সময়ে অতীতের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে বিরোধী পক্ষ বিএনপির পদক্ষেপ গ্রহণের অক্ষমতা ভোটারদের বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল থাকতে বাধ্য করেছে।

একটি বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই একমত হব যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দল ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক বিষয় যে আমরা দশম সংসদের মত আগামী সংসদেও এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এক্ষেত্রে অবশ্যই এর দায় নিয়ে বিএনপিকে জাতির সামনে ক্ষমা চেয়ে অচিরেই তাদের রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে হবে। তাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্রমাগত ভুলের জন্য বারবার জনগণ কর্তৃক শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। সুতরাং নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান নয়, একে গ্রহণ করতে হবে স্বাচ্ছন্দে, নয়ত আগামী দিনে তাদের রাজনীতি আরও কঠিন করে তুলবে বাংলার জনগণ।

এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিএনপির জ্ঞাতার্থে তাদের কৃত কিছু ভুলকে তাদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই যা তাদের আত্মশুদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।

প্রথমত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি দল যখন সরকার গঠনের স্বপ্নে নির্বাচনমুখী হয় তখন সঠিক নেতৃত্বের অধীনে তাদের পরিচালিত হতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের দণ্ডপ্রাপ্তি এবং একজনের কারাগারে এবং অপরজনের বিদেশে আত্মগোপনের পরও তাদের স্থলে কোনো বিকল্প নেতৃত্ব তৈরী করতে ব্যর্থতা এবং নির্বাচনে বিজয়ী বা বিরোধী দলে গেলে কে তাদের সরকার প্রধান বা বিরোধীদলীয় নেতা হবেন এমন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতার ফলে নির্বাচনের ফলাফলে তাদের বিপর্যয় তাদের বিরোধী দলের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রেও অযোগ্য করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে তাদের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে বিরোধী দলের সারিতে গিয়ে বসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, তারা নির্বাচনে ভোট বিপ্লবের প্রত্যাশা করেছিলেন, অথচ কী কারণে সরকারের অনেক সাফল্যের বিপরীতে তাদের প্রতিই জনগণ আস্থাশীল থাকবে সে বিষয়ে তাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তারা হয়ত ভুলেই গিয়েছিল যে তাদের অংশগ্রহণে সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে তারা ২৯ টি আসন লাভ করেছিল এবং তাদের সহযোগী জামায়াত পেয়েছিল ২টি আসন। এক্ষেত্রে বিএনপি এবং জামায়াত মিলে গত ১০ বছরে এমন কী করেছে যে তাদের অবস্থান এর চেয়ে ভাল হবে?

তৃতীয়ত, ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে তারা ঐক্যফ্রন্ট নামক নির্বাচনী জোট গঠন করলেও নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ড. কামাল হোসেন এই বলে বোমা ফাটিয়েছেন যে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে থাকলে তিনি কখনই ঐক্যফ্রন্টে থাকতেন না এবং নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলে সরকার গঠনে জামায়াতের অংশগ্রহণ থাকলে সেই সরকারে তিনি থাকবেন না। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বিএনপির জামায়াতের প্রতি যে গোপন মোহ রয়েছে তা ঐক্যফ্রনন্টের সাথে বিএনপির সম্পর্ককে জমিয়ে তুলতে পারেনি। নামে ঐক্যফ্রন্ট অথচ ঐক্যফ্রন্টের সব দলকে ১৯ এবং নিবন্ধন হারানো জামায়াতকে এককভাবে ২২ টি আসন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে এটাই সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে ড. কামাল গংরা সরকারের বিরুদ্ধে একাট্ট হয়ে বিএনপিকে ক্ষমতাসীন করার অশুভ পায়তারা করছে। জনগণ সময়মত এর জবাব দিয়ে দিয়েছে।

চতুর্থত, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে যে কোনো রকমের ছুতোয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে – নানা মহলের এমন সন্দেহের জবাবে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা কোনভাবেই নির্বাচন বর্জন করে সরকারকে সুবিধা আদায় করতে দেবেন না। বাস্তবে আমরা নির্বাচনের দিন দেখলাম শীর্ষ নেতারা নির্বাচন নিয়ে তাদের সন্তোষের কথা জানালেও দূপুর নাগাদ ৯৬ জন প্রার্থী এক এক করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা করেন, যা পরাজয়ের সাথে তাদের জন্য ‘নেক্কারজনক’ বিশেষণ যুক্ত করেছে।

পঞ্চমত, যে দলটি মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হয়েছে এবং নিবন্ধন হারিয়েছে, যে দলের প্রতি বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীরা আস্থাশীল নয়, যারা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে ঘৃণিত এবং প্রত্যাখ্যাত সেই জামায়াতকে আস্তাকুড় থেকে তুলে এনে তাদের জন্য ২২টি আসন ছেড়ে দিয়ে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে বিএনপি আগামী দিনের জন্য কোন বাংলাদেশ গড়তে চায় তা উপলব্ধই করতে বাংলার জনগণের কষ্ট হয়নি।

উপরের কয়েকটি বিষয় যদি পরাজিত শক্তি একটু মনযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে তবে তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হবে যে কোনো অর্জনই কষ্টহীন অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতীত অর্জিত হয় না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বর্তমান অর্জনের এই ধারায় পৌছুতে কি ধরণের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তাদের বিগত সময়কে অতিবাহিত করেছে সেটা কি পরাজিত শক্তি উপলব্ধি করেছে? বাংলাদেশের সচেতন ভোটাররা এবারের নির্বাচনে সুষ্পষ্টভাবে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে জনগণের নামে রাজনীতি করতে গেলে জনগণকে যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝিয়ে ভোট নিয়ে নেয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে।

জনগণের এই ইতিবাচক উপলব্ধির ফলে আমরা এখন স্বপ্নের সিঁড়িতে, যা আমাদের আগামী দিনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাংলাদেশে পৌঁছে দেবে – এটাই এখন এই সময়ের উপলব্ধি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর