ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও পশ্চিমা জগৎ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-12-31 11:59:57

বৈশ্বিক মহামারী করোনার উত্থান-পতনের পটভূমিতে অকস্মাৎ এক ভয়াল যুদ্ধের মধ্যে ২০২৩ সাল শুরু হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেনের সেই যুদ্ধ চলছে। তার মধ্যেই বছরের শেষপ্রান্তে ইসরায়েল একতরফা ভাবে প্যালেস্টাইনের নিষ্ঠুরতম ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে। বাস্তবে তা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা বা জেনোসাইড। ২০২৪ সাল বিদায়ী ২০২৩ সালের রক্তপাত ও নরহত্যাকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হতে যাচ্ছে।

২০২২ সালের শেষে দ্য গার্ডিয়ান একটা তালিকা প্রকাশ করে বলেছিল, ‘আগামী বছর’ মানে ২০২৩ সালে ফিলিস্তিনে ‘দ্য থার্ড ইন্তিফাদা’র সূচনা হতে পারে। ৭৫ বছর ধরে জীবন দিতে দিতে রুখে দাঁড়াতে পারে ফিলিস্তিনি জনতা। খোদ জাতিসংঘ এক হিসাবে দিয়ে বলেছিল, 'জেরুসালেম এবং প্যালেস্টাইনের অধিকৃত অঞ্চলে সাধারণ মানুষ এক ভয়ঙ্করতম— ‘ডেডলিয়েস্ট’— সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। ২০২২ সালে ইসরায়েলি ‘ব্লকেড’ ভয়ানক আকার নিয়েেছে। জবাবে প্যালেস্টাইনিরা ক্রমে যেমন সক্রিয় হয়ে উঠবে।'

ফিলিস্তিনিদের সামনে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনও পথই খোলা রাখেনি ইসরায়েল। বেঁচে থাকলে হলে প্রতিরোধ-যুদ্ধ করতেই হবে ফিলিস্তিনিদের। ফিলিস্তিনিদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে আগ্রাসী ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে পাশ্চাত্য জগৎ। বিশেষ করে আমেরিকা এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসরায়েলের পেছনে। অস্ত্র ও কূটনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি যুদ্ধবাজ ইসরায়েলকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা।

যদিও কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু দেশ চাইছে, এখনই যুদ্ধ বন্ধ হোক। কিন্তু আমেরিকা তা চাইছে না। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার এই অবিচল সমর্থনের কারণ কী?

প্রধান কারণ, ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আসা ইহুদিদের সংখ্যা আর গুরুত্ব। ১৯৩০ দশকের বছরগুলো থেকেই জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে প্রবল জাতিবিদ্বেষের হাত থেকে পালিয়ে আমেরিকায় উদ্বাস্তু হিসেবে আসতে থাকেন ইহুদিরা। কেবল সংখ্যাই নয়, আমেরিকার ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থব্যবস্থা, মিডিয়া, রাজনীতি এবং বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানে রয়েছেন ইহুদিরা। তাই ইসরায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কও বরাবর খুব ঘনিষ্ঠ। সারা পৃথিবী অন্য কথা বললেও আমেরিকা ইসরায়েলের পক্ষ সমর্থন করে গেছে, অন্তত ৪৭ বার নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলকে বাঁচানোর জন্য ভেটো প্রয়োগ করেছে।

ফলে আমেরিকা এবং অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের ধামাধরা অনুগত স্তাবক ও সমর্থক। তারা কখনও গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে যাননি। ক্ষতি, চুরি, বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান আর জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রের প্রাণঘাতী হামলা সহ্য করে যে লাখ লাখ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম গাজায় কোনও রকমে বেঁচে আছে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। পশ্চিমারা যা করছে, তা হলো, জটিল একটি গল্পকে নিজেদের মতো করে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন। তাদের বয়ানের মোদ্দা কথা হলো, ইসরায়েলিরা খুবই ভালো মানুষ, সব সময় নিষ্পাপ, তাঁরা ভুক্তভোগী। এই পৃষ্ঠপোষকতা নেতানিয়াহু'কে দানবে পরিণত করেছে। তিনি এখন 'ফিলিস্তিনের হিটলার'।

পক্ষান্তরে পশ্চিমাদের চোখে ফিলিস্তিনিরা সব সময় দোষী, ষড়যন্ত্রকারী, সন্ত্রাসী। কাজেই তাদের জীবন বাঁচানোর অধিকার নেই। তাদের খাবার ও পানি অবরুদ্ধ গাজায় বন্ধ করা যাবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়াও ‘সঠিক’। যেসব দিশাহারা ফিলিস্তিনি পরিবার বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ওপর বোমাবর্ষণ করাও ‘বৈধ’। এমনকি, বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শিশুদের নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছোটা অ্যাম্বুলেন্সে হামলা ‘অমানবিক’ নয়। ইসরায়েল সাদা ফসফরাস বর্ষণ ও গণহত্যা 'জায়েজ'।

ইসরায়েল ও আমেরিকার বক্তব্য, হামাস বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার অধিকার ইসরায়েলের আছে। সেই নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে তখনই, যখন হামাস সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। কিন্তু হামাসের সেনারা গাজ়ার ঘনবসতি শহরগুলোয় সাধারণ মানুষের পিছনে আর মাটির নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকে। কাজেই তাদের নির্মূল করতে হলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবেই। এমনকি বহু লোক মারাও যাবে। কত লোক? ইসরায়েলের হিসাব অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের হানায় ১,১৩৯ জন ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছিল। ইসরায়েলের প্রতি-আক্রমণে গাজ়ায় আজ পর্যন্ত ২২,০০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

ইসরায়েলের আত্মরক্ষার একতরফা অধিকারের বিপরীতে প্যালেস্টাইনের মানুষের কি ন্যূনতম আত্মরক্ষার অধিকার নেই? গাজ়া এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের পুলিশ আর সেনাবাহিনী ইসরায়েলের অন্যায় দখলদারির বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের কোনও মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-ধর্মঘট, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলার এতটুকুও দিচ্ছে না। অধিকারহীব মানুষ অনিবার্য ভাবেই গড়ছে সশস্ত্র জঙ্গি প্রতিরোধ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এক সময় ছিল ফাতাহ গোষ্ঠী, গাজ়ায় এখন আছে হামাস।

সশস্ত্র পন্থা নিতে বাধ্য হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। কারণ তাদের কোনও স্বীকৃত রাষ্ট্র নেই। কোনও স্বীকৃত সেনাবাহিনীও নেই। হামাসের সদস্যরা পেশাদার সৈনিক নয়। তাদের আলাদা কোনও ছাউনি, ব্যারাক বা ‘বেস’ নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থেকেই তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সাধারণ মানুষের পিছনে লুকিয়ে নেই। তারা সাধারণ মানুষের সাথে আছে।

সুতরাং গাজ়াকে হামাসমুক্ত করতে হলে তাকে জনশূন্য করে ফেলতে হয়। অথবা এমন অবস্থা তৈরি করতে হয় যে সেখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসরায়েলের যুদ্ধনীতির সেটাই প্রধান উদ্দেশ্য। এরই মাঝে উত্তর গাজ়া এখন প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে একেবারেই বাসের অযোগ্য। মধ্য গাজ়াও দ্রুত সেই দিকে যাচ্ছে। সেখানকার মানুষ নিরুপায় হয়ে দক্ষিণে পালিয়ে এসেছেন। যেখানে আগে হয়তো এক-দেড় লক্ষ মানুষ থাকতেন, সেখানে এখন আশ্রয় খুঁজছেন প্রায় বিশ লক্ষ। সমস্ত গাজ়া জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ, দোকান-বাজার বলতে কিছু নেই। খাদ্য নেই, জ্বালানি নেই। খোলা মাঠের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে হাজার হাজার মানুষ কোনও রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।

এরই মাঝে শীত এসেছে। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা বলছে, গত দু’মাসে তাদের শতাধিক কর্মী গাজ়ার বোমাবর্ষণে মারা গিয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ না হলে তারা গাজ়ার মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে পারবে না। অথচ খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সেখানে মহামারী আর দুর্ভিক্ষের আশু সম্ভাবনা।

সবাই বলছে, ‘এই সর্বনাশা হত্যালীলা বন্ধ করো’। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না। ইসরায়েলের যত দিন প্রয়োজন, তত দিন তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। যুদ্ধ ও গণহত্যার মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিন দখল করা জায়নবাদী ইসরায়েলের উদ্দেশ্য। সবকিছু দখল করে ইসরায়েল যে দিন বলবে, যথেষ্ট হয়েছে, সে দিন যুদ্ধ থামবে। তার আগে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর