শেখ হাসিনার বিজয়গাথা ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী | 2023-08-20 05:01:49

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছে। এ নির্বাচনে তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে পরাজিত করেছে। নির্বাচনের ফলাফল বলছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ২০টি আসন পেয়েছ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭টি আসন পাওয়ায় ভোটের দৌড়ে তারা তৃতীয় অবস্থানে আছে। এ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট ডাবল ডিজিট আসনও পায়নি।

তবে স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার এ বিজয়ে বিরোধী পক্ষ এক ধরনের বিতর্ক জুড়ে দিয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ৮২ বছর বয়স্ক প্রখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। তিনি ইতোমধ্যে এ নির্বাচনকে এক ‘প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছেন। একই সাথে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুননির্বাচনও দাবি করেছেন। ড. কামাল হোসেন নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন তথা নানা প্রকার হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের প্রার্থী ও ভোটারদেরকে হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। এসবই আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটের অভিযোগ।

এদিকে ভারত তথা সার্কের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নির্বাচন কেন্দ্রিক এক ধরনের সহিংসতা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্ষাপটে এ ধরনের সহিংসতা ও নির্বাচনী অনিয়মকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। সে হিসেবে এবারের নির্বাচনে যে সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে তা খুব অস্বাভাবিক নয়।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের নজিরবিহীন সহিংসতা


২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের দায়িত্বে ছিলাম। সে সময়ে সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতা আমি দেখেছি।

নির্বাচনের আগে ও বিজয়ের পরে তারা যে সহিংসতা করেছে তা নজিরবিহীন। নির্বাচনের পরে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নানাভাবে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। কাজেই,  বাংলাদেশের রাজনীতি তথা নির্বাচনে শক্তি ও সহিংসতা-সন্ত্রাসের উপস্থিতি নতুন কিছু নয়।


একাদশ সংসদ নির্বাচন এক নতুন দিনের পথ নির্দেশক

কিন্তু তারপরও এবারের নির্বাচনটি এক নতুন দিনের পথ নির্দেশক। নতুন প্রজন্ম এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এ দ্বি-মেরুকরণ তথা বিভাজনটি সমাজে নানাভাবেই  দৃশ্যমান।


একটি ধারায় রয়েছে তথাকথিত ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ ও অপরদিকে আছে পাকিস্তানপন্থী বিএনপি। কিন্তু নতুন প্রজন্ম ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি জোটের সন্ত্রাস ও সহিংসতা এখনও ভুলে যায়নি। তৎকালীন বিএনপি সরকারের দুর্নীতি, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ  ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহতা নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগকে বেছে নিতে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।


১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীদের বিএনপি-জামায়াত জোট নানাভাবে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে আশ্রয় দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারও অংশীদার হয়েছে। অনেক যুদ্ধাপরাধী বিএনপি সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। বাংলাদেশের আপামর জনগণ এ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। ফলে দেশবাসী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারকে নিরন্তর সমর্থন দিয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল কারিগর ছিলেন জিয়াপু্ত্র তারেক জিয়া।  দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়া আজ কারাগারে ও তারেক জিয়া আজ লন্ডনে পালিয়ে আছেন। মামলায় জামিন নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে আছেন। ইতোমধ্যে দেশে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক মামলার রায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ফলে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। তারেক জিয়া লন্ডনে বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। কিন্তু নিজ দেশের আইনে মানি লন্ডারিং ও হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য  তারেক জিয়া একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। উল্লেখ্য, লন্ডন যেন দণ্ডপ্রাপ্ত ও ফেরারি আসামিদের এক নিরাপদ অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতেরও অনেক পলাতক সেখানে আশ্রয় নিয়ে আছে।  এবারের নির্বাচনে এ বিষয়গুলোও একেকটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলেই মনে হয়।

সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আজ এক শক্ত ভীতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচনে বিজয়ের পরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় আসায় দিল্লি আনন্দিত। তিনি পুননির্বাচিত হওয়ায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক আরো গভীরতর হবে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এক অনন্য মাত্রা যোগ হবে যা দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমাধানে আরো গতি সঞ্চার করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। 

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার।

‘হিন্দুস্থান টাইমস’ থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪।

এ সম্পর্কিত আরও খবর