বিশুদ্ধ রাজনীতির বাতিঘর আশরাফ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা, বার্তা ২৪.কম | 2023-08-29 20:13:14

‘আমাদের রক্ত খাটি, আমাদের রক্ত পরীক্ষিত। আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগ। আমি এটাকে দল কোনো দিনই ভাবি নাই। আওয়ামী লীগকে ভাবছি একটা অনুভূতি। একটা অনুভূতির নাম। রক্ত, বঙ্গবন্ধুর রক্ত। হাজার হাজার আওয়ামী লীগের মৃত্যুতে, আন্দোলন সংগ্রামে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই অনুভূতির নামই হল আওয়ামী লীগ।’- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২০ তম সম্মেলনে এভাবেই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেষ বক্তব্য দিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

লাখো জনতার উপস্থিতিতে সেদিনের সেই সমাবেশে আমিও ছিলাম। দেখেছিলাম সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে মানুষের হৃদয়ছোঁয়া আবেগ। তিনি টানা দুইবার দলের সাধারণ সম্পাদক, কিন্তু তবুও নেতাকর্মীরা তাকে আবারো সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান। তার নাম নিলেই কর্মীদের চোখে-মুখে দেখা যায় শ্রদ্ধা। অবশ্য ঘটনাবহুল সেই সম্মেলনের মধ্যদিয়ে সৈয়দ আশরাফ সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তারপর রাজনীতির মাঠে আর সরব হননি। বরং পর্দার আড়ালে থেকেই নিভৃতে দলের জন্য কাজ করে গেছেন ‘ক্রাইসিস ম্যান’ খ্যাত সৈয়দ আশরাফ। যখনই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কিংবা তার দল আওয়ামী লীগ যখনই কোনো ক্রাইসিসে পড়েছে আমরা দেখেছি সৈয়দ আশরাফ পর্দার আড়াল ভেদ করে বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে দাঁড়াতে, দৃঢ়হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরে ক্রাইসিস মুহূর্তগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় সৈয়দ আশরাফের ভূমিকা তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১/১১’র সময় যখন রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা। আওয়ামী লীগে যখন ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে, দল থেকে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে দলের কিছু ‘সিনিয়র নেতা’ ষড়যন্ত্রের পন্থা অবলোপন করেছিলেন তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফই আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন।  

২০১১ সালে সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যদিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পুনর্বহাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি প্রমার্জ্জনা, নারীদের জন্য সংসদে ৫০ টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়। বিএনপি, জামায়াত তখন এটা নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করে রাখে। তখন সৈয়দ আশরাফ সংশোধনীর আইনি ব্যাখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিলেন। বিরোধীদের আপত্তি চুপসে যায়।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীদের নগ্ন উল্লাসে রাজধানী ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় কয়েকটা কথা হেফাজতের তান্ডবলীলায় পানি ঢেলে দিয়েছিল। এভাবেই সৈয়দ আশরাফ শেখ হাসিনা ও দলের প্রশ্নে সারাজীবন আপোষহীনভাবে কাজ করে গেছেন।

অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সৈয়দ আশরাফ প্রায়ই বলতেন, ‘আমার কাজ দুইটি। এক, নেত্রীকে সবসময় সিকিউর (নিরাপদ) রাখা। দুই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আবারো ক্ষমতায় নিয়ে আসা।’ আর এই দুইটি কাজও করতেন খুব সন্তর্পণে। নিজের কাজই যেন ব্যহত না হয় সেজন্য নিজের সামনে একটি কৃত্রিম দেয়ালও তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। আমরা অনেকেই শুনেছি, সৈয়দ আশরাফ দুপুর একটা পর্যন্ত ঘুমায়, বিকেল বেলা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বাইরে যায়। নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করার সময় পেতেন না এমনকি অনেক সময় সৈয়দ আশরাফকে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যেত না। দপ্তরেও অনুপস্থিত থাকতেন। এই মিথগুলো ছড়ানো হয়েছিল যাতে কোন রকম কোনো নেতা-কর্মী, মন্ত্রী/এমপি কেউ যেন এই দেয়াল ভেদ করে তার কাছে না পৌঁছাতে পারে। এইসব মিথের সবকিছুই ছিল সৈয়দ আশরাফের নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার কৌশলমাত্র।

সৈয়দ আশারাফের স্নেহধন্য সাংবাদিক হাসান জাহিদ তুষার। তার কথায়, ‘সৈয়দ আশরাফ একটা বিষয় নিয়ে সবসময় বেশি ভয় পেতেন সেটা হল নেত্রীর নিরাপত্তা। আর এ বিষয়টি নিয়ে নিজেই কাজ করতেন। উনি মনে করতেন যে এখনো দলের ভেতরে ও বাইরে খন্দকার মোস্তাকরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। প্রায়ই ১৫ আগস্টের বক্তব্যে এ ধরনের কথাগুলো উনি বলতেন। সেজন্য উনি নেত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় শঙ্কিত থাকতেন। এবং সেজন্য দলের মানুষের সাথে দেখা করা, মানুষের সাথে দেখা করা বাদ দিয়ে নেত্রীকে নিরাপদ রাখার জন্য নিজেকে মানুষের কাছ থেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। সমস্ত প্রকার লোভ, ক্ষমতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের সঙ্গে আশরাফ ভাইয়ের ছিল বিশেষ যোগাযোগ। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিয়ে রাশিয়া, চায়না, ভারত, আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের আপডেটেড ইনফরমেশনগুলো তার কাছে সবার আগে আসত। তিনি সেগুলো নিজ দায়িত্বে দেশি ইন্টেলিজেন্স সোর্স থেকে যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে তারপর অ্যাকশন নিতেন। নির্দেশনা দিতেন।’

সৈয়দ আশরাফ ছিলেন ভীষণ বইপ্রেমী। রাত জেগে জেগে পড়াশুনা করতেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতির বিষয়গুলোর উপর ছিল তার বিশেষ দখল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খবরে নিজেকে সবসময় আপডেট করে রাখতেন। দিনের শুরুতেই দেশি-বিদেশি পত্রিকার হেডলাইন থাকত তার ঠোঁটের ডগায়।

আওয়ামী লীগকে কীভাবে আবারো ক্ষমতায় আনা যায় সেটাও তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। দলকে ক্ষমতায় আনতে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। কীভাবে সরকারকে আবারো ক্ষমতায় আনা যায় সেটার লক্ষ্যে দেশে বিদেশে কাজ করা, বিদেশী রাষ্ট্রদের সমর্থন আদায় করা। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, মিলিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, রাজনীতি, দল সবগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনা, বিরোধীদলকে রাজনৈতিকভাবে কৌশল/বুদ্ধি দিয়ে মোকাবেলা করার স্ট্রাটেজি নির্ধারণ করতেই পছন্দ করতেন তিনি।

১/১১’র পর টালমাটাল আওয়ামী লীগকে সৈয়দ আশরাফ শুধু ঐক্যবদ্ধ করেননি পাশাপাশি দলের মধ্যে ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। সে সময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, শেখ হাসিনার অনুসারীদেরকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে আনা ছিল তার আরেকটা চ্যালেঞ্জ। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজের যে অবস্থান সেটা ভুলে তিনি শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করে গেছেন। দলে যেখানে অন্যান্যরা ‘মাইম্যান’ তৈরিতে ব্যস্ত সেখানে নিজের কোনো অনুসারী তৈরি না করে শেখ হাসিনার জন্য দলকে ঐক্যবদ্ধ করে গেছেন।

সৈয়দ আশরাফ বলতেন, ‘এটা শেখ হাসিনার দল, বঙ্গবন্ধুর দল, এই দলে কোন ব্যক্তিগত পছন্দ চলবে না।’ দলের নেতৃত্ব বিকশিত করতে জুনিয়রদের সুযোগ দিতেন তিনি।

সাংবাদিক লাবণ্য ভূইয়ার কথায়, ‘আশরাফ ভাইয়ের সাথে আমার পেশাগত জীবনের ও অনেক স্মৃতি। একদিন গণভবনের বারান্দায় আমি,তাওহিদ মিথুন ভাইসহ অনেকে আশরাফ ভাইকে একা পেয়ে বললাম ,ভাই আপনি প্রেস কনফারেন্স করেন না কেন। উত্তরে বললেন,আমি যদি সব করি তাহলে মাহবুবুল আলম হানিফ, দিপু মনিকে দেশের মানুষ চিনতো। নেতা তো তৈরি করতে হবে।’

মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ কেমন ছিল? সেটা বলি সাবেক সচিব আবু আলমের কথায়। আবু আলম বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে তাঁর সাথে কাজ করার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। গণকর্মচারী হিসেবে অনেকের সাথে কাজ করেছি কিন্তু সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। অতি সজ্জন, বিনয়ী, মৃদুভাষী, নির্লোভ মানুষ হিসেবে তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, অসরকারি সংস্থা এবং গনমানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। তিনি কখনও কোনো অন্যায় কাজ করার জন্য অনুরোধ করেননি, চাপ প্রয়োগ তো দূরের কথা। আইনে বাধা থাকায় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজকে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন এক শতক জমিও দিতে অনুরোধ করেননি। অফিসে খুব কম আসলেও জরুরি নথিপত্র নিষ্পত্তিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। নির্লোভ এই মানুষটির বিরুদ্ধে কেউ কোন দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি।’

শেষ করি ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে। একবার সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের একটি দল নিয়ে চীন সফরে গেছেন। কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন সফরে। একই হোটেলে থাকতেন সবাই। সৈয়দ আশরাফ সস্ত্রীক সফরে ছিলেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে একদিন সকালে সৈয়দ আশরাফের টাকার দরকার হয়। অথচ তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। তখন তিনি সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে ৫০০ ডলার ধার নেন। একইদিন বিকেলে তিনি ওই ডলারই আবার ফেরত দিয়ে দেন। বলেন, ‘আপনাদের ভাবী কেনাকাটা করেনি, তাই ডলার খরচও হয়নি।’

ওই সফরে থাকা সাংবাদিক হাসান জাহিদ তুষার বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তাও আবার মন্ত্রী, টাকা ছাড়াই বিদেশ সফরে আসেন, ধার নেন, সেটা আবার ফেরত দেন এমন দৃশ্য ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ এমনি। সাদামাটা, নির্লোভ। একদম বিশুদ্ধ।’

সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামীলীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও শরীরে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি ব্যথা পায়, আমারও হৃদয়ে ব্যথা লাগে। কেননা আমার রক্ত, আপনার রক্ত সেই একই রক্ত। কোন দ্বিধা নাই।’

সত্যিই যেন তাই। আগামী প্রজন্মকে সেই রক্তের উত্তরাধিকার করে চিরবিদায় নিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। ওপারে ভালো থাকুন আওয়ামী রাজনীতির বাতিঘর!

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান
সাবেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংবাদিক বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর