আপনার ‘বিকল্প’ এ জনপদ কবে জন্ম দিবে আবার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মামুনুর রশীদ | 2023-08-26 05:42:36

ভোরবেলা কোনো এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। সামাজিক মাধ্যমে চোখ বুলাতেই ছোট ভাই পাভেল রহমানের কিছু অভিব্যক্তি সৈয়দ আশরাফ কে নিয়ে। সেই অভিব্যক্তি দিয়েই স্মৃতিচারণটা শুরু করছি। ‘আমরা কথায় কথায় আমাদের নেতাদের নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে হুটহাট নির্দিষ্ট দল / সিস্টেম কে দায়ী করে বসিনা? এইটা আসলে অহেতুক ! আমার মনে হয় কি নেতা তৈরী হওয়া না হওয়া কিংবা ভালো বা খারাপ হওয়ার দায় মূলত একটা জনপদের।

বঙ্গবন্ধু , তাজউদ্দিন কিংবা নজরুল ইসলামেরা কিন্তু একদিনে অমনি অমনি আসেনি , টুঙ্গীপাড়া থেকে একটু একটু করে কাঁচামাটির বয়স পেরিয়ে নিজেকে গড়ার সুযোগ পেয়েছেন খোকা , রাজপথের পিচগলা উত্তাপ সে নরম মাটিকে রঙ আর কাঠিন্য এনে দিয়েছে , বঙ্গতাজ দিনের পর দিন কাপাসিয়া-জয়দেবপুর-নারায়ণগঞ্জ এর হাজার মাইল কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিয়েছেন তার সাধের বাইসাইকেলে করে, গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক, ক্ষেতের মাঝখানে গোপন মিটিং, বিপ্লবের স্বপ্ন আর মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধ তাঁকে বড় করেছে ... সৈয়দ নজরুলেরা মানুষ কে ভালোবাসতে জানতেন, তাঁরা এক ডাকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে জড়ো করে ফেলতে পারতেন যারা সত্যি সত্যি বৈঠা-কাস্তে-লাঙল-হাতের ঝুড়ি ফেলে শুধু ভালোবেসে নেতার কথা শুনতে এ প্রান্ত ও প্রান্ত থেকে কোমড়ে মুড়ি গুড়ের টুপলা গুঁজে বের হয়ে যেত।

যাই হোক , ইতিহাস বলা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য না, যে কথায় ছিলাম, নেতা তৈরীর দায় জনপদের, তাঁদের জন্ম হয়েছিল কারণ তাঁরা এই জনপদের নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন , বাংলাদেশে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প সংসদে কথা বলে যায়না , কথা বলেন আমার এলাকার অমুক মিয়ার ছেলে তমুক কিংবা আপনার এলাকার তমুক বাড়ির জামাই অমুক - মানে আমরা আমরাই, এক এলাকায় সবগুলো মানুষ চুরি করে দোতলা বাড়ি করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোরদের প্রতিনিধি হিসেবেই এক চোর নেতাই সংসদে যাবেন , এক এলাকায় অধিকাংশ লোক শিক্ষিত হলে শিক্ষিত নেতাই অধিকাংশে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন ... মানে আমাদের নেতা আমাদের কেউই হন - আমরা অধিকাংশই পান খেয়ে অফিসের সিঁড়ির দেয়াল নোংরা করি বলেই আমাদের নেতাদের রুচির দৌঁড়েও শহরের ড্রেন আর নদীর পানির পরিচ্ছন্নতা কুলায় না... তো বহু দশক ধরে আমরা ঠিক একটা চোরপ্রধান জনপদের গ্রুপ থেকে চোর নেতা, ইয়াবা ব্যবসায়ী প্রধান এরিয়া থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী নেতা অথবা ফাপরবাজ প্রধান এলাকা থেকে ফাপরবাজ নেতা ( মানে যারা যেমন তাদের নেতা তেমন সূত্র) ছাপিয়ে জাতীয় নেতা তৈরী করে উঠতে পারিনি , সর্বজনসমৃদ্ধ রাজপথ আর খোলা আকাশের গনগনে সূর্যের উত্তাপে পুড়ে পরিণত হওয়া নেতা পাইনি।

কিন্তু এই না পাওয়ার ভীড়ে ব্যতিক্রম একজন সৈয়দ আশরাফ , জাতীয় নেতার ছেলে হিসেবে পাওয়া রাজনৈতিক স্টারডম ছুড়ে , চকলেট চকলেট কিউট নেতা না হয়ে তিনি বরং অনেকখানি মাটির, অনেকখানি মানুষের ঘামের গন্ধের, নষ্ট ফসলের সামনে বসা কৃষকের কান্নার জলের- মোদ্দা কথা তিনি শুধু কিশোরগঞ্জের না হয়ে, ছিলেন আমাদের সবার, এই জাতির। পরিপূর্ণ , বর্ষীয়ান , মানুষের অকৃত্তিম ভালোবাসার এই মানুষটা আর নেই ভাবতে পারছিনা, মৃত্যুর আগের শেষ ইলেকশনেও তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত সৎ এই মানুষটি শেখ হাসিনার পর আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রাণের বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তাঁকে অবশ্যই মনে রাখবে তাঁর নির্লোভী, ডেডিকেটেড, রাজনৈতিক দূরদর্শী, বিশ্বাসী আর সাংগঠনিক যোগ্যতার গুণাবলীর জন্য।

আর বাংলার মানুষ তাঁকে ভালোবাসবে তাঁর সৌম্যশান্ত অবয়ব, নেতৃত্বগুণ আর মানুষকে ভালোবাসবার প্রচন্ড আকাক্সক্ষার জন্য। একজন সৈয়দ আশরাফ বছর বছর আসেনা, গত ত্রিশ বছরে আসেনি, আবার কবে আসবে জানিনা, এই নষ্টদের ভীড়ে, নষ্ট সময়ে হাল ধরবার জন্য তাঁর মত নেতা পেতে আমাদের আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হয় কে জানে তা! ওপারে ভালো থাকবেন সৈয়দ আশরাফ, আপনার বিকল্প এ জনপদ কবে জন্ম দিবে আবার?’

নির্লোভ আর নিরহঙ্কারী একজন সাদা মনের মানুষ জাতির পিতার ঘনিষ্ট সহচর জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আশরাফ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। অসংখ্য শহীদের রক্ত মিশে আছে এই নামটির সাথে। এই নামের প্রতিচ্ছবি অবারিত হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন সৈয়দ আশরাফ। সৈয়দ আশরাফ শুধু একটি নাম নয়, এই নামটি মিশে আছে আওয়ামী লীগের স্মৃতির পাতায়। পিতার রক্তের গর্বিত সিপাহসালা ছিলেন তিনি। বাঙালির জন্ম জন্মান্তরের মুজিবাদর্শের প্রেমের ঠিকানা ছিলেন আপনি ও আপনার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

বারবার দলের দুঃসময়ের ঝা-া বহনকারী হিসেবে বেশ সুপরিচিত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১ জানুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সৈয়দ আশরাফ ছিলেন একাত্তরের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির পরিম-ল ছিলো বেশ সুপ্রসন্ন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর রক্ত পিপাসুদের রক্তের পিপাসায় হারাতে হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকেও। ৩ নভেম্বর পিতার মৃত্যুর পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাস কালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি লন্ডনস্থ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। সৈয়দ আশরাফ ফেডারেশন অব বাংলাদেশী ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ) এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে আশরাফুল দেশে ফিরে আসেন। বর্নাঢ্য রাজনীতিক জীবনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুইবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সপ্তম ও অষ্টম, কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এর পূর্বে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন।

এছাড়াও তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। যখন আব্দুল জলিল গ্রেপ্তার হন, তখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন। এই দম্পতির মেয়ে রীমা ঠাকুর, যিনি লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যতদিন বাংলাদেশের বুকে থাকবে ততদিন সৈয়দ আশরাফের নাম স্বার্ণাক্ষরে অঙ্কিত থাকবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আরেক অবারিত আলো দেয়া মানুষ, যেখানে চন্দ্র, সূর্যের আলো না থাকলেও অন্ধকার আসেনি সেই মানুষটি আর নেই কথাটির মধ্য দিয়ে দলটির এক অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেল। নির্লোভ এই মানুষটি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক আজীবন। আমরা মহান মানুষটির বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ এই মহান মানুষটিকে জান্নাত নসিব করুন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফ বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন। দেশরতœ শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেয়ার আগে বলেছিলেন যতদিন সৈয়দ আশরাফ রয়েছে ততদিন ওই আসনে আমি অন্য কাউকে মনোনয়ন দিবো না। তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তিনি শপথ নিতে পারেননি। একজন সৈয়দ আশরাফ এখন আমাদের অনুভূতি, আর অনুপ্রেরণার নাম হয়ে থাকবে। ভালো থাকবেন নেতা!

লেখক: মামুনুর রশীদ, সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর