রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: আমেরিকার আগ্রাসী পরিকল্পনার অনিবার্য পরিণতি

, যুক্তিতর্ক

নাজমুল হাসান | 2024-01-09 12:46:49

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যান্য সকল যুদ্ধ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্ত মারামারি, রেষারেষি ও বিবাদের মীমাংসা শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমেই হয়। যদিও ততদিনে ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ, ক্ষতিসাধন হয় ব্যাপক সম্পদের, মানবতা হয় বিপর্যস্ত। আলোচনার মাধ্যমে যে বিবাদের সমাধান সম্ভব নয়, যুদ্ধ করেও সে বিবাদের সমাধান অসম্ভব।

ইউক্রেনকে বলির পাঁঠা বানিয়ে আমেরিকা, ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব তাদের বৈশ্বিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ করছে। যদিও এখন আর এটিকে ছায়াযুদ্ধ বললে পুরোপুরি ঠিক হবে না, কারণ এই পুঁজিবাদী দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেকটা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যদিও যুদ্ধটি চলছে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে কিন্তু এই যুদ্ধে জিতলে জিতবে ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব, হারবে রাশিয়া; অথবা জিতবে রাশিয়া, হারবে ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব। এখানে ইউক্রেনের জয়-পরাজয় বলে কিছু নাই, তাদের কপালে আছে শুধুই ধ্বংস, শুধুই পরাজয়।

রাশিয়া যদি হেরে যায় তবে ইউক্রেন বড় জোর তার হারানো চারটি প্রদেশের ভূখণ্ডগত মালিকানা ও অখণ্ডতা ফিরে পাবে কিন্তু যে ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন দেশটি হয়েছে সেখান থেকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। রাশিয়া হেরে গেলে আমেরিকা, ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে যে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করবে সেটা হবে তাদের এই যুদ্ধে পরাজয়ের থেকেও বড় পরাজয়।

ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলো অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা বাদে প্রায় সবকিছুর জন্য রাশিয়া ও এশিয়ার দেশগুলোর উপরে নির্ভরশীল। অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা বাদে ইউরোপ মহাদেশের এ দেশগুলো আমেরিকার কাছ থেকে অন্য কোনো সহায়তা পায় না। তারপরেও কেন ইউরোপের এই দেশগুলো প্রতিবেশী রাশিয়া ও এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না রেখে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে এবং তাদের কথায় ওঠে বসে সেটা জানা দরকার। এর কারণ হলো, ইউরোপের এই দেশগুলো স্বাধীনভাবে মতামত রাখার মতো স্বাধীন দেশ নয়, এরা পরাধীন, আমেরিকার কাছে বন্দি।

পর্যাপ্ত তথ্য না জানা থাকার কারণে ইউরোপের এ স্বাধীন ও উন্নত দেশগুলো সম্পর্কে আমার এ মন্তব্য হঠাৎ বেমানান মনে হতে পারে, অর্থাৎ তারা যে আমেরিকার কাছে পরাধীন ও বন্দি সে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। ফলে আমার মন্তব্যের কারণ আমি ব্যাখ্যা করছি যাতে এ বিষয়ে বাস্তব সত্য উপলব্ধি করা যায়। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকা বিশ্বব্যাপী তার ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য অক্ষশক্তির তিনটি দেশ জার্মানিতে ১৭২টি, ইতালিতে ১১৩টি এবং জাপানে ৮৪টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তাদের নিজের অধীন করে দাবিয়ে রেখেছে। এ দেশগুলোর পক্ষে আমেরিকার মতামতের বাইরে কোনো প্রকার স্বাধীন মতামত দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

৬৭ বছর আগে কোরিয় উপদ্বীপের যুদ্ধ শেষ হলেও আজ‌ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার ৮৩টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, সৌদি আরব, কাতার ও কেনিয়াসহ বিশ্বের ৮০টি দেশে আমেরিকার ৮০০ জ্ঞাত সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে তাদের অনেক অজ্ঞাত সামরিক ঘাঁটি, যার খবর কেউ জানে না। বিশ্বের পাঁচটি দেশে রয়েছে আমেরিকার তৈরি পারমাণবিক অস্ত্রের সামরিক ঘাঁটি।

আমেরিকার স্বার্থে আঘাত লাগলে সে যেকোনো দেশকে ধ্বংস করে দিতে সে একবার‌ও ভাববে না। আমেরিকা কখনো কারো বন্ধু নয়, সবসময়েই ধান্দাবাজ ও স্বার্থবাজ। আমেরিকার বন্ধু হওয়ার চেয়ে তার শত্রু হওয়া অনেক উৎকৃষ্ট। আমেরিকার বন্ধু হ‌ওয়া মানে সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে অবিবাহিত থাকা।

১৯৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা ও কিউবার ক্ষমতা দখল করার জন্য সেখানে 'বে অব বিগস' নামে একটা সশস্ত্র দল পাঠায়, যদিও তারা সফল হতে পারেনি। ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা ও কিউবার পতন ঘটাতে আমেরিকা অনেকবার চেষ্টা করেছে। আমেরিকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিউবা তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তাদের দেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুরোধ জানায়। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রশ্চেভ কিউবার অনুরোধে সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি গড়ার ঘোষণা দেন। রাশিয়ার এ সিদ্ধান্ত শুনে মার্কিন শাসক কেনেডি বলেছিলেন সেটা করা হলে, তিনি কিউবাতে মিসাইল হামলা করে গুড়িয়ে দেবেন। যুদ্ধ এড়ানোর জন্য রাশিয়া তখন কিউবায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। একটা শক্তিশালী দেশ কখনোই চাইবে না তার পাশের দেশ এমন কোনো শক্তিশালী দেশের ইন্ধন পাক যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

এটা কে না জানে যে, ১৯৪৯ সালে ন্যাটো গঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তথা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করা। এর বিপরীতে ন্যাটো গঠনের ৬ বছর পরে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের রাজধানীতে ওয়ারস জোট গঠন করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারস জোট বিলুপ্ত হয়ে যায়। ন্যাটো জোট যদি ভালোই হতো তবে এরপরে তারা ন্যাটোকেও বিলুপ্ত করে দিতো। তারা তা করেনি বরং শুরুর সদস্য সংখ্যা ১২টি দেশ থেকে তা তারা ৩০টি দেশে উন্নীত করেছে। যে পোল্যান্ডে বসে ওয়ারস জোট তৈরি হয়েছিল সেই পোল্যান্ডকেও তারা ন্যাটোর সদস্য করেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে ১৫টি দেশ হয়েছিল তাদেরকে নিয়ে রাশিয়ার নেতৃত্বে সিআইএস বা কনফেডারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্ট এস্টেট গঠন করা হয়েছিল। সিআইএস এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর কোনো সদস্য ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। ন্যাটো এই সিআইএসভুক্ত ৩টি দেশ লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়াকে তাদের সদস্য করে রাশিয়াকে বুড়ো আঙুল দেখায় এবং রাশিয়াকে ধ্বংসের জন্য রাশিয়ার সাথে যেসব দেশের সীমান্ত আছে সেসব দেশকে ন্যাটোর সদস্য বানাতে পিছে লেগে তাকে। এটা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ১৯৯১ সালে রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর দুর্বল ছিলো বলে কিছু করতে পারেনি। কিন্তু তখনকার রাশিয়া আর এখনকার রাশিয়া এক নয়। এখন কেনো সে তা সহ্য করবে?

তেল লুট করার জন্য ২০০৩ সালে আমেরিকা মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকের উপরে আক্রমণ করে দেশটাকে তামা তামা করে ফেলে। এক সময়ে বাদশাহ হারুনুর রশীদ ও তার স্ত্রী যোবেদা খাতুনের বিপুল সম্পদ ও ঐশ্বর্য দিয়ে সাজানো বাগদাদকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শ্মশানে পরিণত করে। আমেরিকার সাথে সেই যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল ও ডেনমার্ক যোগ দেয় এবং সরাসরি সৈন্য পাঠায়। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬০টি দেশে ৩০ মিলিয়ন মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। ইরাক যুদ্ধে নিহতদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। একেক সূত্র একেক রকম তথ্য-উপাত্ত দেয়। বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংগ্রহ পদ্ধতিতে জানা যায়, প্রথম তিন বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার যা পরে হয় ১০ লক্ষ। ইরাক সরকারের কম্প্রিহেনসিভ তথ্যানুসারে এই যুদ্ধে ২০ লাখ ইরাকি বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে আছে।

পানামা খালের দখল নেওয়ার জন্য আমেরিকা পানামা আক্রমণ করে এবং সে দেশের শাসক ডেনিয়েল নরিয়েগাকে ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি পানামা থেকে বন্দি করে আমেরিকায় নিয়ে আসে এবং নিজেদের দেশেই তার বিচার করে। সারা বিশ্ব তখন নিশ্চুপ ছিলো। কোনো মানবতার প্রশ্ন তখন কেউ করেনি। এখন রাশিয়া জেলেনস্কিকে সেভাবে ধরে নিজের দেশে নিয়ে বিচার করলে নিশ্চয়ই বিশ্ব মানবতায় আঘাত লাগবে।

১৮৪৬-১৮৪৮ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস কে পোলক মেক্সিকো আক্রমণ করে এবং টেক্সাস দখল করে সেটাকে আমেরিকার ভূখণ্ড করে নেয়। এ সময়ে মেক্সিকোর ভূখণ্ডের ৩ ভাগের ১ ভাগ আমেরিকার দখলে চলে যায়। তখন‌ও বিশ্ব চুপ করে ছিলো, কেউ কিছু বলেনি। কারণ, কাজটা করেছে আমেরিকা। আমেরিকা করলে তাতে কিছু হয় না।

নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানোর জন্য আমেরিকা ১৮৯৮ সালে স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং ১৬,০০০ স্প্যানিশ সৈন্যকে হত্যা করে। তখন কে কী বলেছে আমেরিকার বিরুদ্ধে?

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপানিদের বোমা বর্ষণের পরদিনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রজোটে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানি ও ইতালি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার তিন দিন পরই যুক্তরাষ্ট্রও দেশ দু’টির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান কোনো কারণ ছাড়া জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার নির্দেশ দেয়। ধ্বংস করা হয় জাপানের মানব সভ্যতা। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পিছনে সঙ্গত কারণ আছে। ইউক্রেন রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার সহায়তায় গোপনে মারিওপোলে জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছে। বার বার নিষেধ সত্ত্বেও সে ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে পিছপা হয়নি। রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ার তার নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবে।

১৯৫০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ থেকে উৎখাত করতে কোরিয়ার সাথে যুদ্ধ করে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ বছর ধরে চলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এটি ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যেকার লড়াই। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট মিত্রদেশ উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল; অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট-বিরোধী মিত্রদেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল। আমেরিকা ভিয়েতনামের মাটিকে তামা করে রেখে গেছে।

২০০১ সালে শুরু হয় আফগান যুদ্ধ যা মূলত এখনো চলছে। ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল-কায়েদা আমেরিকায় হামলা চালিয়েছে এমন অভিযোগে আফগান সরকারের কাছে লাদেনকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানায় আমেরিকা। তালেবানরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ সংঘাতে ৩২ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোক মারা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করে।

লিবিয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে। তাদের প্রতি ব্যারেলে উৎপাদন খরচও সবচেয়ে কম। আমেরিকা এই তেলের জন্য ২০১১ সালে লিবিয়ার উপরে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করে সেই থেকে তার তেল সম্পদ লুটে খাচ্ছে। সিরিয়ার তেল লুট করার জন্য আমেরিকা সেখানে আইএস তৈরি করেছে এবং হাফিজ আল আসাদ সরকারকে পতনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। রাশিয়া সিরিয়ার সরকারকে সহযোগিতা করছে বলে এখনও সিরিয়া টিকে আছে ন‌ইলে এতো দিনে আমেরিকার পেটে চলে যেতো।

পৃথিবীতে ইজরাইল নামে কোনো দেশ ছিলো না। ওখানের দেশটি ছিলো প্যালেস্টাইন। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব ও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য আমেরিকা প্যালেস্টাইনিদেরকে তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে এবং তাদের ভূখণ্ড দখল করে সেখানে ইহুদিদেরকে এনে জড়ো করে, দখলকৃত ভূখণ্ডের নাম দেয় ইজরাইল। আজ ইজরাইল একটি দেশ কিন্তু প্যালেস্টাইন কোনো দেশ না। কী অদ্ভুত। আমেরিকার সমর্থনে ইজরাইল ইচ্ছেমতো প্যালেস্টাইনিদেরকে হত্যা করছে। নিজের দেশেই তারা পরবাসী। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মুসলিম দেশও প্যালেস্টাইনিদেরকে সরাসরি কোনো সহায়তা দিতে পারেনি। এই প্রথম রাশিয়া সরাসরি প্যালেস্টাইনিদেরকে সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছে।

আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। কেন? সে শক্তিশালী হতে চায়, ইজরাইলের বিরোধিতা করে, আমেরিকার কথা শোনে না এবং আমেরিকাকে ইচ্ছে মতো তাকে তেল দেয় না বলে?

ইরানকে বাগে আনার জন্য মধ্য-এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো মিলে মার্কিন ঘাঁটির সংখ্যা অন্তত ২৫টি। গ্লোবাল রিসার্চে প্রকাশিত তথ্যমতে বিশ্বের ১৫৬টি দেশে আমেরিকা ৩,৫০,০০০ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে। এসব সেনা প্রয়োজন হলে যে-কোনো জায়গায়, যে-কোনো সময় সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এজন্য বিশ্বে খুব কম দেশ আছে যারা মার্কিন সরকারের আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য নয়, আমেরিকার কাছ থেকে তারা নিরাপদ এবং স্বাধীন।

রাশিয়ার নর্ডস্ট্রিম-২ পাইপ লাইনের মাধ্যমে মূলত জার্মানিতে গ্যাস যাওয়ার কথা এবং সেখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে তা সরবরাহ হবে। এই পাইপ লাইনে আমেরিকা সাবমেরিন দিয়ে গোপনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে তাকে ধ্বংস করে জার্মান-সহ ইউরোপকে চরম বিপদে ফেলতে চেয়েছে তবু জার্মান বা ইউরোপের দেশগুলো আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছে না। আমেরিকা বলছে এটা রাশিয়া করেছে এবং ইউরোপের দেশগুলো তাতে সমর্থন দিচ্ছে। যে পাইপ লাইনের ৫৫% শেয়ার রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাজপর্মের সেটাতে যে রাশিয়া হামলা চালাবে না, একথা পাগলেও বোঝে। রাশিয়া ইচ্ছে করলে গ্যাস বন্ধ রাখবে, নিজের পাইপ লাইনে সে কেন হামলা করে নষ্ট করতে যাবে? সব বুঝেও ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের মহা-বিপদ এড়ানোর জন্য আমেরিকার কথায় সায় দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

ইউক্রেনে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি ছিল না। রাশিয়াকে বাগে আনার জন্য সেখানে তার সামরিক ঘাঁটি করার প্রয়োজন ছিল আর সে কারণেই আমেরিকা কৌশলে ইউক্রেনকে ফুঁসলিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। ইউক্রেনের কৌতুক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সেটা বোঝার ক্ষমতা ও বিচক্ষণতা কোনোটাই নাই।‌ এদিকে আমেরিকার ভয়ে স্বাধীন মতামত প্রদানে ব্যর্থ ইউরোপের দেশগুলো অনন্যোপায় হয়ে নিজেদের ক্ষতি বুঝেশুনেই আমেরিকার পক্ষে দালালি করতে বাধ্য হচ্ছে। ইউরোপের দেশে দেশে আমেরিকার বিরুদ্ধে এবং রাশিয়ার পক্ষে মিছিল, আন্দোলন হওয়ার পরেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর কিছু করার থাকছে না।‌ সব বুঝেও তাদের মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হচ্ছে নতুবা আমেরিকার শেখানো বুলি আওড়াতে হচ্ছে। আসন্ন শীতে নিজেদের জনগণের স্বার্থে তেল-গ্যাসের সমস্যা সমাধানের জন্য রাশিয়ার সাথে স্বাধীনভাবে আলাপ পর্যন্ত করতে পারছে না।

বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র রাশিয়া স্বাধীনভাবে চলে এবং আমেরিকার কথায় কর্ণপাত করে না। এটা আমেরিকার পছন্দ নয়, সে চায় পৃথিবীর সমস্ত দেশ তার কথায় চলবে এবং তার কাছে মাথা নত করবে। আর এ কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার এমন ক্ষোভ। এজন্য রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য রাশিয়া-সহ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে থাকা রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক পদক্ষেপ এবং নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ। আমেরিকার পদলেহি জাতিসংঘ নামক একপেশে সংস্থার দ্বারা এসব দেশের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে নানা অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা ও বহুবিধ নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ। অথচ হাজারো অপকর্ম করার পরেও জাতিসংঘ কর্তৃক আমেরিকার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

আমেরিকা যেমন অন্যদেশকে বাগে রাখার জন্য কলোনিয়াল বা উপনিবেশ কৌশল প্রয়োগ করে, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে, অস্ত্র-সৈন্য রেখে তাদেরকে নিজের পক্ষে রাখতে বাধ্য করে, তাদের সম্পদ লুট করে- রাশিয়া তা করে না। রাশিয়া শুধু নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে চলতে চায়। অন্যদেশকে বাগে রেখে তাদের সম্পদ আহরণ করা রাশিয়ার নীতিগত উদ্দেশ্য নয়। বরং শক্তিশালী কোনো দেশ যাতে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্য কোনো দেশের উপর প্রভুত্ব করে তাদের ধন-সম্পদ লুট করতে না পারে রাশিয়া সে কাজ করে। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব হলো লুটেরা। রাশিয়া এদের লুটপাটে বাধা দেয়, সে জন্য এরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে এককাট্টা। 

এই চলমান যুদ্ধে রাশিয়া যদি হেরে যায় তাহলে সারা বিশ্বকে আমেরিকার পদানত হয়ে থাকতে হবে। ফলে আমেরিকা তার স্বার্থে ইচ্ছেমতো পৃথিবীর যে-কোনো দেশের উপর যতো অন্যায়, নির্যাতনই করুক না কেন তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো পৃথিবীতে আর কোনো দেশ থাকবে না। পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য বলতে কিছুই থাকবে না। সারাবিশ্ব শাসন করবে এক মোড়ল, আমেরিকা। সে যা বলবে তাই করতে হবে, কোনো দেশের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। তখন সব রাষ্ট্রের অবস্থা হবে এখনকার প্যালেস্টাইনের মতো।

বিশ্বের এই শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই যুদ্ধটা একটা সুযোগ। স্বাধীন মতামত রাখতে চায় এমন দেশগুলো যদি এখন রাশিয়ার পক্ষে চলে আসে তাহলে বিশ্ব শক্তির এই ভারসাম্য রক্ষা হবে। ওপেকভুক্ত দেশগুলো ইতোমধ্যে তেল উৎপাদন সংক্রান্ত যে মতামত দিয়েছে তা রাশিয়ার পক্ষে গেছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ক্ষমতা পারমাণবিক অস্ত্রের থেকেও বেশি। তেল না পেলে আমেরিকা সোজা হতে বাধ্য। এতে প্যালেস্টাইন সমস্যার‌ও সমাধান হবে।

ইউক্রেন দেশটি ইরাকের মতো শেষ হয়ে গেছে, এর কিছু নাই, সব ধ্বংসস্তূপ। এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের নামে যুদ্ধ করছে ন্যাটো। যদিও পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেনের দ্বারা রাশিয়ার অধিকৃত দুচারটে গ্রাম, কয়েকশো বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করেছে মর্মে ইউক্রেনের পক্ষে বিজয় প্রচার করছে কিন্তু এটা সঠিক চিত্র নয়। প্রায় সমগ্র ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় চলছে। অথচ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব সেসব চেপে রেখে ইউক্রেনের ক্ষমতা দেখানোর জন্য ইউক্রেনের ভিতরে থাকা ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর দ্বারা রাশিয়ার ভিতরে হুটহাট করে আক্রমণ চালাচ্ছে। এসব আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা মহা-ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেনকে এভাবে ধ্বংস করাই আমেরিকার উদ্দেশ্য। রাশিয়া ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে চায় না, চায় আমেরিকা। রাশিয়া ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে চায় না বলেই সে এই অভিযানকে বলছে বিশেষ সামরিক অভিযান। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষ থেকে এটাকে যুদ্ধ বলা হচ্ছে না।‌ ইউক্রেন প্রথম থেকে রাশিয়ার কথা শুনলে রাশিয়া ফিরে যেতো, এ যুদ্ধ হতো না। এখন আমেরিকা সেটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করাকে অসম্ভব করে তুলেছে।

এখন ইউক্রেন স্বাধীন মতামত দেওয়ার অবস্থায় নাই, সে আমেরিকার কথায় চলছে। ইচ্ছে করলেও এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কথা বলতে পারবে না। যদি ইউক্রেন সন্ত্রাসী হামলা না করে তবে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযান চালাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে পুতিন যুদ্ধ শেষ করতে চাইছে কিন্তু আমেরিকা তা চাইছে না। এজন্য ন্যাটো বাহিনী দিয়ে ইউক্রেনের ভিতর থেকে সরাসরি রাশিয়ার ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধ জিইয়ে রাখছে।

এখন বিশ্বের অনেক দেশ যদি রাশিয়ার পক্ষে আসে যাতে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় শুধুমাত্র তখন‌ই আমেরিকা ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে বসে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলবে, নতুবা নয়। এখন আমেরিকাকে বাগে এনে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসানোই যুদ্ধ বন্ধের শেষ ভরসা। যুদ্ধ বন্ধের নিয়ামক রাশিয়ার হাতে নয়, আমেরিকার হাতে। রাশিয়া তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এ যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আমেরিকা ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন করেছিল এবং সেটা রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে বার বার বলার পরেও ইউক্রেন তাতে কর্ণপাত না করায় রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এই বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করতে‌ বাধ্য হয়েছে।

রাশিয়া শুধু ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ করছে না সে যুদ্ধ করছে সমগ্র দখলদার ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে, ৪০টি দেশের বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছে। এ যুদ্ধে যদি রাশিয়া হেরে যায় তবে ন্যাটোভুক্ত দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অবস্থাই হবে প্যালেস্টাইনের মতো। এই ন্যাটোও তখন আর ন্যাটো থাকবে না। রাশিয়া ভেঙে গেলে শিয়াল আমেরিকা সবাইকে মুরগির মতো ছিঁড়ে খাবে।

এখন যদি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয় তবে পুরো পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে- তাতে না থাকবে আমেরিকা, না থাকবে রাশিয়া, না থাকবে মানুষ। রাশিয়াকে যুদ্ধে হারানোর চিন্তা একটা কাল্পনিক বিষয়। পৃথিবীর অর্ধেক পারমাণবিক অস্ত্র যার হাতে তাকে হারানো যাবে না, প্রয়োজনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। রাশিয়ার এমন সিস্টেম করা আছে যাতে অন্য দেশের পারমাণবিক হামলায় যদি রাশিয়ান ভূপৃষ্ঠের ভূখণ্ডে একজন মানুষও জীবিত না থাকে তবে তার পারমাণবিক অস্ত্র সক্রিয় হয়ে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে। সুতরাং রাশিয়াকে পরাজিত করার চিন্তা একটা অলীক স্বপ্ন। ফলে আলোচনাই এ যুদ্ধ বন্ধ ও পৃথিবীকে রক্ষা করার একমাত্র পথ। আমেরিকাকে বাধ্য করতে হবে সে যেন ইউক্রেনকে আলোচনায় বসায়। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। শক্তি নির্মূল করা সম্ভব নয় ফলে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে শক্তির ভারসাম্য দরকার। একমাত্র রাশিয়ার বিজয়‌ই সে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

নাজমুল হাসান: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর