স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই থাকুক

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-01-10 18:07:52

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ী সকল প্রার্থীদের শপথগ্রহণ শেষ হয়েছে। পদ-পদবি, সুবিধাদি প্রাপ্তির পাশাপাশি দায়িত্বও এসে জুটেছে তাদের। সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন, আইন প্রণেতা বলা হয় তাদের। তবে নির্বাচিত যারা এবং যারা নির্বাচনে লড়েছেন তাদের কাউকে ভোট টানতে আইন প্রণয়ন নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। সকলেই বলেছেন উন্নয়নের কথা, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উন্নয়নের। ভোটাররা একজন সংসদ সদস্যের কাছে এটাই চায় বলেই কি-না তাদের প্রতিশ্রুতি ও বক্তব্যে কেবলই উন্নয়ন আর প্রতিশ্রুতি।

দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এই নির্বাচনে অনুমিতভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তাদের প্রাপ্তি ২২২ আসন। একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পার্টির প্রাপ্তি মোটে ১১ আসন, একটি করে আসন পেয়েছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ফল ঘোষিত ২৯৮ আসনের মধ্যে বাকি ৬২টি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যে দুটো আসনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি সেই ময়মনসিংহ-৩ আসনের একটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে আগামী ১৩ জানুয়ারি। একজন প্রার্থীর মৃত্যুতে স্থগিত হওয়া নওগাঁ-২ আসনের পুনঃতফসিল হয়েছে এবং নতুন তারিখ আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। আগের প্রার্থীদের বহাল রেখে, আবার আছে নতুন করে মনোনয়নপত্র জমাদানের বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নির্বাচন কমিশন।

আজ শপথগ্রহণের পর কাল নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সর্বসম্মতিতে শেখ হাসিনাকে সংসদ নেতা, মতিয়া চৌধুরীকে সংসদ উপনেতা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিরিন শারমিন চৌধুরীকে স্পিকার এবং শামসুল হক টুকুকে আবারও ডেপুটি স্পিকার হিসেবে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা প্রথম বৈঠকেই সংসদ দ্বারা নির্ধারিত হবে। এছাড়া বর্তমান হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটনকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মন্ত্রিসভায় কারা আসছেন এটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। একাদশ মন্ত্রিসভার তিন প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়া এবং নির্বাচনে আরও তিনজনের বিজয়ী না হতে পারায় এই ছয় শূন্যস্থানে নতুন মুখের দেখা পাওয়া নিশ্চিত। এরবাইরে আছে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সুবিধা। গত মন্ত্রিসভায় অন্তত তিনজন ছিলেন এই কোটার। এই তিন তিনে নয়ের শূন্য পদ রয়েছে মন্ত্রিসভায়। কাল সেটা পূরণ হতে পারে।

শপথগ্রহণ, মন্ত্রিসভা গঠন—এগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগে থেকে দেশে একটাই আলোচনা কারা বসছেন বিরোধীদলের আসনে? নির্বাচনের পরেও এই প্রশ্ন চলমান। আওয়ামী লীগের বাইরে দল হিসেবে জাতীয় পার্টির রয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন। সংখ্যার দিক থেকে এটা মাত্র ১১ হলেও আর কোন দলের নাই এত আসন। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দুজন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তবে একমাত্র কল্যাণ পার্টির মুহাম্মদ ইবরাহিম নির্বাচিত হয়েছেন নিজস্ব প্রতীক হাতঘড়ি নিয়ে। এরবাইরে যে ৬২ আসন স্বতন্ত্রের, তাদের নির্দিষ্ট কোন দল নেই। তারা আইনত বিরোধীদল হতে পারে কি-না এনিয়েও নানা বিজ্ঞজনের নানা মতামত রয়েছে। তবে এবারের স্বতন্ত্ররা কি সত্যি সত্যিই স্বতন্ত্র—এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে ঢের!

এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এরআগে এত বেশি সংখ্যক স্বতন্ত্রের জয় দেখেনি দেশ। এই স্বতন্ত্রদের অধিকাংশই আবার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আগে এমন প্রার্থিতায় দল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিত, বহিস্কার করত। কিন্তু এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। দলের নির্দেশে নির্বাচনে স্বতন্ত্র হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী গণভবনে সকল মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ডেকে নিয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় উৎসাহিত করার পাশাপাশি স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দিতে কোন প্রার্থী যদি চাপ প্রয়োগ করেন তবে তার/তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও নির্বাচনি প্রচারণার পুরোটা সময় স্বতন্ত্রদের পক্ষে বলেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে ‘কোট-আনকোট’ করার পাশাপাশি তারা যে আওয়ামী লীগার সেটাই প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশমূলক দেখাতে আওয়ামী লীগের এই কৌশলে সারাদেশে প্রায় উন্মুক্ত ছিল নির্বাচন। অনেক জায়গায় স্বতন্ত্রীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পারলেও বেশ কিছু আসনে নৌকা ও লাঙল প্রতীকের প্রার্থীকে চরম পরীক্ষায় ফেলেছেন। নির্বাচনে জয়ী ৬২ স্বতন্ত্রের মধ্যে অন্তত ৫৯ জন আওয়ামী লীগ নেতা। অপর যে তিনজন তাদের একজন ধর্মভিত্তিক সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ হুছাম উদ্দিন চৌধুরী। স্বতন্ত্র হয়ে জেতা আরেকজন সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। আর অন্যজন জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত নেতা মোহাম্মদ সিদ্দিকুল আলম, যিনি দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ে ‘সমঝোতায় পাওয়া আসনে’ নিজ দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র এই তিনজনের আসন যথাক্রমে সিলেট-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ এবং নীলফামারী-৪। স্বতন্ত্র হয়ে বিজয়ী এই তিনজনের মধ্যে দুজন রাজনৈতিক নেতা, এবং অন্যজন ধর্মীয় নেতা। 

স্বতন্ত্ররা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং আসন ভাগাভাগির অংশ জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের সঙ্গে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন। তবে শুরু থেকে তারা আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়ার কথা বলছেন না। নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে জয়ী হয়ে যাওয়ার পরেও তারা বলছেন—তারা আওয়ামী লীগ থেকে এসেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবেন। নিজের দলের প্রতীকে নির্বাচন করা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক যে আওয়ামী লীগের বাইরে যে যাবেন এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তার আসনে ছিলেন না আওয়ামী লীগের প্রার্থী, উপরন্তু দলটির নেতাকর্মীরা নির্বাচনি প্রচারণায় ছিলেন মুহাম্মদ ইবরাহিমের সঙ্গে। জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত যে নেতা সিদ্দিকুল আলম যে সরকারবিরোধী ভূমিকায় সরব হবেন সে লক্ষণও এখন পর্যন্ত নেই। খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা একরামুজ্জামান সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে এসে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, বিজয়ী হয়েছেন। ধর্মভিত্তিক সংগঠন আল ইসলাহর সভাপতি ফুলতলী পীরের ছেলে হুছাম উদ্দিন চৌধুরী সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত, এবং নির্বাচনের আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও এসেছেন। তিনিও সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে যাবেন না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, সংসদে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছাড়াও বাকি সবাইও কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের অংশ হিসেবে নিজেদের প্রমাণে বসেছেন।

২৯৮ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বাইরে আরও দুজন ভোটে নির্বাচিত হবেন। এরবাইরে সংরক্ষিত আসনের আরও ৫০ জন আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য হবেন। এখান থেকেও কেউ সরকারের বাইরে থাকছেন না। ফলে দ্বাদশ সংসদের বড় অংশ আওয়ামী লীগ, আর বাকি অংশ স্বতন্ত্র-জাতীয় পার্টি আর কল্যাণ পার্টি নামে হলেও আওয়ামী লীগ হয়েই থাকবে। এমতাবস্থায় একপেশে সংসদ থেকে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতখানি হবে এনিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

জাতীয় পার্টির ১১, স্বতন্ত্র নির্বাচিত ৬২ জন এবং কল্যাণ পার্টির একজনকে দিয়ে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করা যেত। চাইলে তারা জাতীয় সংসদে পারত গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে এই আশা পূরণ হচ্ছে না। ফলে কার্যকর দ্বাদশ সংসদের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ও কিছু জায়গায় জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে লড়ে বিজয়ী স্বতন্ত্রীরা নিজেদেরকে আওয়ামী লীগ প্রমাণে ব্যস্ত। একটা নির্বাচন শেষ হতে না হতেই তাদের চোখে এখন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার আশা। দলের নেতা, কিন্তু দলের বিরুদ্ধে গেলে এলাকায় উন্নয়ন করতে পারবেন কি-না এই শঙ্কাও অনেকেই মনে। ফলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে সংসদকে কার্যকর করার বৃহত্তর চিন্তা।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিজেদের আওয়ামী লীগ প্রমাণের দরকার নাই। তারা নিজেদের সামর্থ্যে জয়ী হয়েছেন, ভোটের মাঠে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন, জনতার সমর্থন পেয়েছেন; এখন দরকার জনতার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের, সংসদকে কার্যকর করার দায়িত্ব নেওয়ার। নিজেদের শক্তিতে জয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদে গিয়ে যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়ে যান তবে তারা তাদের নিজেদের ক্ষমতাকেই অশ্রদ্ধা করলেন, অগ্রাহ্য করলেন জনতার রায়কে। দলীয় প্রতীক-সংবেদনশীলতা অতিক্রম করেই জনতা ভোট দিয়েছে নতুন প্রতীককে। জনতার এই রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বতন্ত্ররা আওয়ামী লীগ নয়, স্বতন্ত্রই থাকুক!

এ সম্পর্কিত আরও খবর