পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোট বিমুখতা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-01-13 12:45:01

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে দেশেবিদেশে বহুমুখী আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে ভোট প্রদানের হার কোথাও কোথাও কম হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে দৃশ্যমান হয়েছে 'ভোট বিমুখতা'র চিত্র, যা গভীরভাবে পর্যাালোচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোট বিমুখতা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তার অনুসন্ধান করা জরুরি।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, "বাংলাদেশ সরকার বলছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, আন্তর্জাতিক সূত্র ও সাংবাদিকেরা বলছেন ২৭ শতাংশ। কিন্তু আওয়ামী লীগপন্থী আমাদের পরিচিত অনেকে বলেছেন, ভোট পড়েছে ২০ শতাংশের নিচে। নির্বাচনের দিন ফাঁকা রাস্তা দেখা গেছে, হরতালের মতো। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই বলে থাকেন, গ্রামের তুলনায় শহরে ভোট পড়ে বেশি। আমার চেনাজানাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ভোট দিয়েছেন, ১০ শতাংশের বেশি তো ভোটই দেয়নি।" পরিস্থিতি মোটের উপর এমন হলেও কোথাও ভোটশূন্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি, যা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

উল্লেখ্য, গত ৭ জানুয়ারি সারা দেশে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। চারদিন পর সেই নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। তাতে দেখা যাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৪ এবং চট্টগ্রাম-৩ আসনের দুই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটির আট কেন্দ্রে এবং খাগড়াছড়ির ১৯ কেন্দ্রের কোনও বাক্সে একটিও ভোট পড়েনি। খাগড়াছড়ি আসনে ১৯৬টি কেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪১৯ জন। ৭ জানুয়ারি এ আসনে ভোট পড়েছে ৪৯.৯৯%, অর্থাৎ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৪ জন ভোট দিয়েছেন। তবে ১৮টি কেন্দ্রে কেউ ভোট দিতেই আসেননি। পার্বত্য এলাকা দুর্গম হওয়ায় এবং স্থানীয় দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঝুঁকির কারণে ২৭ কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা। কিন্তু এটিকে একমাত্র কারণ মনে করা যায় না। বরং বিষয়টিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

দেশের পার্বত্য ৩ জেলার ভোটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি, পানছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলার ১৯টি কেন্দ্রে সারাদিনে কোনও ভোট পড়েনি। অন্যদিকে রাঙ্গামাটির ৮টি কেন্দ্রেও কোনও ভোটই পড়েনি। তবে এতগুলো কেন্দ্রে শূন্য ভোটের পরও দুই আসনের একটিতে প্রায় ৫০ শতাংশ আরেকটিতে ৫৯ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়, কুতুবছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শুকনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কোনও ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে যাননি। পাশের পানছড়ি উপজেলার ১১টিতে কোনও ভোট পড়েনি। একটিমাত্র ভোট পড়েছে দক্ষিণ লতিবান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জনের জোরালো আন্দোলন ছিল না। ফলে বিরোধিতার কারণে কেন্দ্রগুলো ভোটশূন্য ছিল বলা যাবে না। আর চলমান উন্নয়ন ধারায় পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ হয়েছে। যোগাযোগ বিঘ্নের কারণে একজন ভোটারও আসতে পারবেন না, বাস্তবে এমন পরিস্থিতি পাহাড়ের কোথাও নেই।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ভোটারদের প্রণোদনা দিয়ে ভোট দিতে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। প্রার্থীরাও ভোটার আনতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু এর কোনও প্রতিফলন পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকগুলো ভোটকেন্দ্রে প্রতিফলিত হয়নি।

কেন এমন হলো? অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের জন্য প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়ার পরেও পাহাড়ের কিছু এলাকার ভোটাররা কেন মুখ ফিরিয়ে রাখলেন? শত চেষ্টাতেও কেন তারা ভোট দিতে আসলেন না। এমন নয় যে, ভোট বর্জনকারী দলগুলো তাদেরকে বিরত রেখেছে। কেউ তাদের প্রতিহত করে নি। তবু তারা ভোট দিতে এলেন না কেন?

তাত্ত্বিকভাবে ভোট না দেওয়া বা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করাকে বলা হয় 'রাজনৈতিক অনীহা'। পাহাড়ের কিছু মানুষের মধ্যে এই রাজনৈতিক অনীহা কেন সৃষ্টি হলো, তা সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, অনীহা যদি ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। শাসন ব্যবস্থা ও অনীহাগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ ছিন্ন বা শ্লথ হবে। যার পরিণতিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হবে মানুষগুলোর।

দুঃখজনক ঘটনা হলো, পাহাড়ে এখনও অনেক সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎপর রয়েছে, যারা উপজাতি জনপদ ও জনগণের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হিংসা ও রক্তপাতের পথে চলছে। তারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে নস্যাৎ করে মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও বিভ্রান্ত করতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু মানুষের ভোট বিমুখতার ক্ষেত্রে এই অশুভ শক্তির ইন্ধন বা উস্কানি রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা অপরিহার্য। যদি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সশস্ত্র পন্থার পাশাপাশি জনসংযোগের মাধ্যমে মানুষকে ভোট, রাজনীতি ও শাসনের প্রতি বিমুখ করতে পারে, তাহলে তাদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি পাবে ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে, যা নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।

এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজের ব্যর্থতাগুলোকে আত্মসমালোচনার আয়নায় দেখতে হবে। কেন তারা মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সক্রিয় ও অংশীদার করতে পারেন নি, তার কারণ নির্ণয় করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধির বিষয়েও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপ্ত বিচ্ছিন্নতা, সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সীমাবদ্ধতাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক অনীহা দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। বহুমাত্রিক সামাজিক পদক্ষেপে মাধ্যমে প্রণোদনা দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক অনীহা দূর করা না হলে তা পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিপদ বৃদ্ধি পেয়ে ভবিষ্যতে তীব্র নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর