পুড়ে অঙ্গার হওয়া জনগণ ও রাজনীতির দায়

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-14 14:49:08

কাওরানবাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী স্বামী মিজানুর রহমানের সঙ্গে দুই সন্তান ফাহিম ও ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন বছর পয়ত্রিশের নাদিরা আক্তার পপি। আমাদের সবার মতোই মিজান-পপি দম্পতিরও হয়ত পরিবার নিয়ে আর ছেলেদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সুখী এই পরিবারের সব স্বপ্নই থেমে গেছে গত ১৯ ডিসেম্বর (২০২৩) ভোররাতে। স্বামীর বাড়ি নেত্রকোণা সদরের বরুনা গ্রামে নাদিরা আক্তার পপি বেড়াতে গিয়েছিলেন সন্তানদের নিয়ে। বেড়াতে গেলে শিশুদের কতই না বায়না থাকে। নিশ্চয়ই ইয়াসিনদেরও বায়না ছিল। বছর তিনের ইয়াসিন হয়ত তার সব খেলনা মায়ের ব্যাগে নিতে পারেনি। ভেবেছিল বাসায় এসে প্রিয় খেলনা নিয়ে খেলতে বসবে। পাশের বাসার শিশু বন্ধুটিও এসে তার খেলার সঙ্গী হবে। খেলনা প্লেন হাতে ইয়াসিনও হয়ত প্লেনে চড়ার বায়না ধরতো। আমার তিন বছরের মহীয়ানও যেমন রোজ বাবার কাছে বায়না ধরে নতুন খেলনা কিনে দিতে, বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার-চিরচেনা এমন আবেগময় আখ্যান আমাদের সবার পরিবারেই আছে।

গেল ১৯ মার্চ (২০২৩) ভোরে মায়ের কোলে শিশু ইয়াসিন ঢাকায় ফিরছিল। স্টেশনে গিয়ে তাদের নিয়ে আসতে বাবা মিজানুর রহমানও যথাসময়ে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্যে এমন এক নির্মম ভোর অপেক্ষা করছিল তা কে জানতো! ‘দুর্বৃত্তদের’ আগুনে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে বহু ঘুমন্ত যাত্রীই অগ্নিদগ্ধ হন। অনেকেই বেরুতে পারলেও চারজন পেরে উঠেনি। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া চারজনের মধ্যে পপি ও তার শিশুপুত্র ইয়াসিন আরাফাতও ছিল। হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় স্বজনদের অনেক মাতমের খবর আমরা এই সময়ে প্রকাশ করেছি।

তারও আগে ১৩ ডিসেম্বরও এই ‘দুর্বৃত্তদের’ কবলে পড়েছিল এ একই ট্রেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। গাজীপুরের বনখুরিয়াতে লাইন উপড়ে ফেলায় সেই দুর্ঘটনায় একজনের প্রাণহানি ও বহু মানুষ গুরুতর আহতও হন। এসব নাশকতায় যাঁরা প্রাণ হারালেন তাদের স্বজনদের আর্তনাদ আর চোখের জল তখনও সিক্ত। এরই মাঝে ৬ ডিসেম্বর (২০২৪) ঢাকার গোপীবাগে বোনাপোল এক্সপ্রেসও একই ভাবে আক্রান্ত হয় ‘দুর্বৃত্তদের’ আগুনে। এ ঘটনাতেও নারীসহ ৪ জনের অঙ্গার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।

আমরা সকলেই জানি, এই ঘটনাগুলো দেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সংঘটিত। আমরা গেল এক দশকে নাশকতার পরিসংখ্যানের যদি হদিস করি নিরপরাধ সাধারণ মানুষের প্রাণহানির দীর্ঘ খতিয়ান তুলে ধরা যাবে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আরোহণে যে প্রবল প্রতিযোগিতা তাতে নিজেদের দাবি মানাতে জনগণকে জিম্মি করার যে প্রচেষ্টা তা আমরা বহু দশক ধরেই এদেশে দেখে আসছি। কিন্তু দলগুলির ক্ষমতায় যাওয়াকে নিশ্চিত করার বিপরীতে এই ধরণের অন্তর্ঘাতমূলক যেসব নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এর দায় কেউ নিতে রাজি নয়। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে বক্তৃতার ফুলঝুরি ছুটিয়ে নিজেদের মহিমা ও গৌরবকে এমনভাবে তুলে ধরতে ব্যঘ্র যে হতভাগ্য সেই মানুষগুলো যাঁরা ক্ষমতায় আরোহণে এক জঘন্য প্রতিযোগিতার বলি হয়ে অকালে প্রাণ হারালেন; তাঁরা সেখানে নেহায়েতই গৌণ হয়ে পড়েন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হতভাগ্য সেই মানুষের প্রাণ বিসর্জন কতটা গৌণ হয়ে পড়তে পারে, তা আমরা এবারও একই রুপে দেখতে পেলাম।

সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে যে নির্বাচনটি হয়ে গেলে তা অপেক্ষাকৃত কম সহিংসতামুক্ত করা গেছে এই বলে ক্ষমতাসীনরা বেশ জিগির তুললেন! আমরা দেখতে পেলাম বেশ দ্রুততার সঙ্গেই শপথগ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ফের একটি নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করল। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ্য করলাম ভুলে যাওয়ার পুরনো সংস্কৃতি মেনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী সকলে পরম উৎসব আমেজে ফুল-মিষ্টি নিয়ে ছুটোছুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অসুস্থ রাজনীতির অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হয়ে পপি-ইয়াসিনদের হত্যাকাণ্ডের যেসব ঘটনা ঘটে গেল সবাই তা বেমালুম ভুলে গেল! প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্রের পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিভৎস অবয়ব এখনও ভুলতে না পারা মিজানুরের হৃদয়ের নীরব চিৎকার ছাপিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার মহানন্দে বিরাট বিরাট মিছিলগুলো আজ অনেক বলিষ্ঠ-উচ্চকণ্ঠ। নির্বাচনে বিজয়ী এমপি ও মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারা ভাগ্যবানদের মিটিংরুম বা অফিসে পুষ্পিত অভিনন্দনের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারানো সেইসব হতভাগ্য মানুষের স্বজদের আহাজারি কোথায় যে মিলিয়ে গেছে তা কেউ জানে না।

কিন্তু রাজনীতি যদি জনগণের জন্যই হয়ে থাকে, তবে সেই জনগণের প্রাণ হরণের দায় দলগুলো নিতে কেনইবা নারাজ? যারা এসব ঘটিয়েছেন অতীতে বা বর্তমানে তাদের ক’জনের মুখোশ আমরা উন্মোচন করতে পেরেছি? ঘটনার পর পরই নানা তদন্ত কমিটি-কমিশন আর কর্তাব্যক্তিদের লম্বা-চওড়া ভাষণ ছাড়া আমরা আর কি পেয়েছি? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরাও তো নাশকতা চালিয়ে এর দায় স্বীকার করে। তবে এই ‘দুর্বৃত্তরা’ কারা? এদের উন্মোচনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কোন প্রচেষ্টার কথা কি আমরা স্মরণ করতে পারব? পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষগুলোর চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় বার্ণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু অগ্নিনাশকতার মুলোৎপাটনে রাজনৈতিক বা বিচারিক প্রচেষ্টা আর কতদূর গড়ালে তবে এসব বন্ধ হবে, এই জিজ্ঞাসারই বা কে জবাব দেবে? তবে কি আমাদের এই জনগণের ঘুমন্ত প্রবণতার কারণেই রাজনীতিবিদরা এমন গোজা মিলের ‘তত্ত্ব’ প্রচার করে আমাদের ঘুম পারিয়ে রাখে?

আমরা কি নবগঠিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের, এই অসুস্থ রাজনীতির বলি হয়ে প্রাণ হারানো ব্যক্তিগুলোর স্বজনদের কাছে সর্বাগ্রে ছুটে যেতে দেখতে পারতাম না? জনগণই যদি তাদের সত্যিকারের আশ্রয় হন তবে তাদের প্রাণ সংহারের বেদনা তারা কেন অনুভব করেননি? রাজনীতির মঞ্চে দেওয়া বক্তব্যের যে সারমর্ম আর সত্যিকারের বেদনাবোধের মাঝে যে পার্থক্য তা বোধহয় এই ‘নির্বোধ’ জনগণও বেশ ভালোই বুঝে। সততা ও নিষ্ঠার যে প্রকট সংকট এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান তাতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মাঝে কমবেশি একটি অভিন্নতা আমরা লক্ষ্য করা যায়।

আমরা দেখেছি, সরকারের মন্ত্রিসভার নবনিযুক্ত সদস্যগণ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শৃঙ্খলিত বাঙালি জাতির মুক্তির নায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যাপিত যে জীবন ও সংগ্রামী আদর্শ, তাঁর যে জনদরদী সত্ত্বা, পীড়িত জনগণের কল্যাণ সাধনের যে ব্যঘ্রতা-সেই পরম্পরাকেই যদি আমরা ধারণ করি তবে সবার আগে সেই পরিবারগুলোর কাছেই তো ছুটে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাদেরকে ডেকে এনে বহু অর্থকড়ি তুলে দেওয়ার চেয়ে এই পরিবারগুলোর বেদনার্ত হৃদয়ের হাহাকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার যে অকৃত্রিমতা, নির্মম এসব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে আগামীতে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করার যে বলিষ্ঠ বার্তাটি জানান দেওয়া প্রয়োজন ছিল, ক্ষমতাসীনরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই দৃশ্যমান।

রাজনীতির নির্মম বাস্তবতার কাছে এই দেশের কত শত পরিবারের এমন নিরব কান্না কয়েক দশকে ফেনায়িত হয়ে এক শোকের সাগর হয়ে গেছে, আমরা ক’জন তার খবর রাখি। কিন্তু আমরা আত্মশ্লাঘা অনুভব করি এই ভেবে যে, সময়ের স্রোতে দেশের অর্থনীতির আকার, আধুনিক অবকাঠামোসহ অনেক কিছুর আকার বৃদ্ধি পেলেও আমাদের মূল্যবোধ ও বিবেকের সামান্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিবেকহীন এই প্রবণতা আমাদের সমাজের প্রগতি ও মানবিক মর্যাদাকে আজ গলা টিপে ধরছে। আমরা এর থেকে উত্তরণের উপায় আজও জানি না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর