ফুটপাতে বাইকারদের দৌরাত্ম্য: এদের থামাবার কি কেউ নেই?

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-15 22:09:21

ঢাকা মহানগরীর কত যে নাগরিক দুর্ভোগ তার সীমা নেই। বর্ষা মৌসুমে সড়কে খোড়াখুড়ি, জলজট, ধুলোবালির অত্যাচার, ঠিক গন্তব্যে গণপরিবহণের স্বল্পতা, পরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, জনাকীর্ণ স্থানে পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা, গ্যাস-পানি না থাকা, গভীর রাতে উচ্চ শব্দে কার-বাইক রেস ইত্যাদি অসংখ্য সংকটে নিত্যদিন নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে।

কর্মমুখী নগরবাসীকে এসবের বাইরে যে সমস্যাটি দীর্ঘদিন থেকেই যন্ত্রণা দেয় তা হচ্ছে, ফুটপাত দখলে নিয়ে হকারদের হাট বসানো। এতে করে চলার পথটি সংকুচিত হয়ে পড়ায় যানজটের সঙ্গে মনুষ্যজটেও এখন নাকাল হতে হয় ব্যস্ত নগরবাসীকে। যানজটে যাত্রার বাহন আটকে গেলে পায়ে হেঁটে যে এগিয়ে যাবেন তারও উপায় নেই। এরই মাঝে নগরবাসীর দুর্ভোগের চিরায়ত তিক্ত অভিজ্ঞতায় আরও একটি নাম যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে।

গেল এক দশক ধরে ঢাকা মহানগরীতে মোটরবাইকের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। বিশেষ করে ‘পাঠাও’, ‘উবার’ ইত্যাদি রাইড শেয়ারিং অ্যাপস চালুর পর থেকে ক্রমান্বয়ে তরুণদের একটি বড় অংশ একটি মোটর সাইকেল কিনে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি একে জীবিকারও বাহন করেছে। ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই ১০ লাখের বেশি মোটর সাইকেল রয়েছে, যা গোটা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর সহজ বাহন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠা এই মোটরসাইকেল চালকরাই এখন নগরবাসীর নিত্যদিনের দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়িয়েই চলছে। কিন্তু সবচেয়ে বিড়ম্বনার এক কারণ হয়ে উঠেছে এখন এই মোটর বাইকাররা। হকারদের ফুটপাত দখলে রাখার অভিযোগের মধ্যেই এখন বাইকারদের দৌরাত্ম্যে ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের চলাচল রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

নিশ্চিন্তে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলার কোনো অবস্থা এখন নেই। পথচারীদের তটস্থ থাকতে হয় কখন দ্রুতগামী কোনো বাইক এসে তার উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা ফুটপাতে ঘটেছে বেপরোয়া বাইকারদের কারণে। পথচারীরা কেউ বাইকারদের এমন দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ জানালে উলটো বাইকাররা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে। কেউ কেউ পথচারীর উপরেই বাইক চালিয়ে দিতে উদ্যত হয়।

ফুটপাতে বাইক দুর্ঘটনার আধিক্যে ২০১২ সালে হাইকোর্ট বিভাগ ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করেন। হাইকোর্ট বিভাগ ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে চালকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশকে নির্দেশও দেন। আইনজ্ঞদের মতে, কোনো রাস্তায় বা জনগণের চলার জায়গায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। মোটরযান অধ্যাদেশ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী এটি দণ্ডনীয় অপরাধ।

আমরা ২০১২ সালে আদালতের এই নির্দেশনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কিছুটা তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব যেন কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে। যে-সব বাইকাররা ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে আইনি শাস্তির কথা ১০ বার ভাবতো, তারাই এখন বীরদর্পে পথচারীদের চলাচলের মধ্য দিয়েই জোরেসোরে হর্ণ বাজিয়ে রীতিমতো গা লাগিয়ে বাইক চলাতে কুণ্ঠিত হন না। কর্তৃপক্ষ ফুটপাতে বাইকারদের এই দৌরাত্ম্য কমাতে ফুটপাতে অসংখ্য লোহার স্থায়ী প্রতিবন্ধক স্থাপন করেছিল। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, কীভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে ফুটপাতে বাইক চলাচলের এসব প্রতিবন্ধক কে বা কারা গোড়া থেকে ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন গোড়ায় দৃশ্যমান লোহার অংশ বিশেষ যেন পথচারীদের নিরাপদ যাত্রার আকাঙ্খাকেই নিয়ত বিদ্রুপ করছে।

টেকসই একটি নাগরিক জীবনের যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের সেখানে সকলকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কোন বিকল্প নেই। ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে যেসব উদ্যত বাইক চালকরা প্রতিনিয়ত আদালতের বিদ্যমান আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন, রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কি নীরব দর্শক হয়েই কেবল থাকবে?

এ সম্পর্কিত আরও খবর