‘সংকোচননীতি দীর্ঘমেয়াদী হলে বিনিয়োগে প্রভাব পড়তে পারে’

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-18 10:18:56

দেশের অর্থনীতিতে সংকোচনমূলক নীতি দীর্ঘমেয়াদী হলে তা বৈদেশিক বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম। তিনি মনে করেন আর্থিক খাতে বিদ্যমান অন্যান্য যে সকল সংকট রয়েছে তা নিরসন করা গেলে তবেই এই নীতি সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতির বিষয়ে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেছেন ড. মোঃ আইনুল ইসলাম। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।  

বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মূল্যায়ন কি?

অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম: সারাবিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগে এটি প্রভাব ফেলতে পারে। আপাততঃ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই নীতি ভূমিকা রাখবে। আমরা গত ৬ মাস দেখেছি এই সংকোচনমূলক নীতি খুব একটা কাজে দেয়নি। এখানে যদি আমাদের অন্যান্য বিষয়গুলি…যেমন-ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা-বিশৃঙ্খলা, খেলাপিঋণ, অর্থপাচার ইত্যাদি রোধ, রাজস্ব নীতিতে মনযোগ দেওয়া-সরকারি খরচ কমিয়ে আনা, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, সরকারি প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করে অতিব্যয়ের লাগাম টানা-এইসবগুলোতে নজর দিলেই ইনফ্লুয়েশনটা কমবে, মুদ্রানীতিটা কাজে দেবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সংকোচনমূলক নীতি দীর্ঘমেয়াদী হলে তা আবার বৈদেশিক বিনিয়োগকে ব্যাহত করবে। বিনিয়োগকারীরা টাকার অধিকমূল্যে নিরুৎসাহিত হবে। সেইদিক থেকে সামগ্রিকভাবে ম্যানেজড একটি পলিসি, বিশেষ করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে নীতিসুদ হারটা বাড়ানো উচিত; যদিও সারাবিশ্বে নীতিসুদ হারটা বাড়িয়েই নিয়ন্ত্রণটা করেছে। আমাদের দেশের এটি খুব একটা কাজ করে না। কারণ অনেকগুলো ফ্যাক্টর এখানে জড়িত।

বার্তা২৪.কম: আর্থিকখাতে সুশাসনের কথা বলছিলেন…কিভাবে তা সম্ভব হতে পারে?

অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম: এক্ষেত্রে আমরা একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। সেই সঙ্গে একাধিক কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যেমন-ব্যাংক কমিশন ইত্যাদি গঠন করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আগামী ২১ জানুয়ারি (২০২৪) এই লক্ষ্যে আমরা সমিতির  একটি সভাও করতে যাচ্ছি।  বিভিন্ন নীতি গ্রহণের পূর্বে আমাদেরকেও ডাকা হয়, সেখানে আমরা আমাদের মতামতগুলো তুলে ধরি। আমাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই মুদ্রানীতি প্রণয়নে একাডেমিশিয়ানও নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বার্তা২৪.কম: নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। দেশের বিদ্যমান অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কি ধরণের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম: আমরা গত এক বছর ধরে এই চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলে আসছি। ১০-১১টি মোটাদাগের চ্যালেঞ্জের কথা আমরা বলছি, যেখানে মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বরে রাখার কথা বলেছি। অভ্যন্তরীন যে বাজারব্য বস্থা তা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। যে সিন্ডিকেটের কথা আমরা বলছি, সেই কয়েকজনের সিন্ডিকেটের হাতেই কিন্তু বাজার পরিচালিত হচ্ছে। বাজার অর্থনীতিতে যদি কোন ইন্টারভেনশন হয় তাহলে কিন্তু সেই বাজার অর্থনীতি যথাযথভাবে কাজ করে না। চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতেই যদি দাম নির্ধারণ হতো তাহলে তো এই সমস্যাটি হতো না। কিন্তু এখানে কৃত্রিমভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চাল আমাদের যথেষ্ট মজুদ আছে, তাহলে কি কারণে কিছু সময় ধরে চালের মূল্যবৃদ্ধি হল তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কোন কারণ খোঁজে পাই না আমরা। একটাই কারণ আছে তা হচ্ছে অতি মুনাফার প্রবৃত্তি। ভোক্তা বা উৎপাদক কেউই এতে লাভবান হন না। হাতবদলের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই আসলে সুবিধাটা নিচ্ছে।

বার্তা২৪.কম: অর্থনীতির অন্যান্য সংকটগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি ফেরাই….

অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম: অন্যান্য বিষয়াবলীর মধ্যে; রিজার্ভের বিষয়ে যেমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। রেমিটেন্সের বিষয়ে, হুন্ডি ব্যবসার লাগাম টানতে খুব যে বড় কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা নয়। তাই এখান থেকে বড় সুফল যা আসতে পারতো তা আসছে না। রেমিটেন্সের বিষয়টা আরও জোরাল পদক্ষেপ নিতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে-রফতানি খাতে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ লোহিত সাগরে হুদিদের আক্রমণ, এটি আমদানি ও রফতানি, উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে। ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। জ্বালানি তেলের সরবরাহেও প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে এখন থেকেই বিকল্প পথ খোঁজা উচিত অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে। আমরা বার বার এগুলো বলে যাচ্ছি। কোভিডের পর পর কিন্তু অনেকগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন, সবশেষ লোহিত সাগরে হুথিদের ক্রমাহত আক্রমণ, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা অভিযান। ইউরোপ-আমেরিকাতে যে আমরা রফতানি করি, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে আমরা আমদানি করি-সবগুলোই কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে লোহিত সাগরে নতুন করে এই উত্তেজনার ফলে। এসবও অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সবকিছু মিলে সুশাসনের মাধ্যমে এবং সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, সর্বোপরি অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ব্যক্তিদের আনাও অত্যন্ত জরুরি, কারণ সাম্প্রতিক কালে আমরা নানাক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা দেখে আসছি। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর