ছোট থেকে বড় যুদ্ধে ইসরায়েল, মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-01-19 12:25:36

জোরজবরদস্তি, গণহত্যা, ভূমি দখল ও হিংসা বহাল রাখতে জন্ম-পরবর্তী ইতিহাসের প্রায় পুরোটা সময়কালেই ইসরায়েল রাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে ছোট যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। এটি তার ভৌগোলিক আগ্রাসন, জনসংখ্যার উগ্র মানসিকতা ও হিংস্র মতাদর্শিক আচরণের সশস্ত্র বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষে গাজায় নৃশংস আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েল সম্ভবত ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ছোট যুদ্ধের পর্যায় বাতিল করে বড় যুদ্ধের দ্বারা ব্যাপক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করেছে। কারণ, জানুয়ারি ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে যুদ্ধ সময়কাল দুই মাস ছাড়িয়েছে এবং অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৪ হাজার পেরিয়ে গেছে। নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রায় সাড়ে ১০ হাজারই শিশু।

ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে ইসরায়েল আরবদের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ছয় এবং কুড়ি দিন স্থায়ী যুদ্ধ করেছিল। অতীতে গাজা অঞ্চলে বেশকিছু যুদ্ধও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধবাজ ইসরায়েল কর্তৃক ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ বা ২০২১ সালের কোনও যুদ্ধই কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। একইভাবে, ২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ মাত্র এক মাস স্থায়ী হয়েছিল।

অনেক বছর ছোট যুদ্ধের পর ইসরায়েল কৌশল বদলে ফেলেছে। এখন ইসরায়েল অনেক বেশি সময় ধরে লড়াই করতে উদ্ধতস্বভাব। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং লেবানন যুদ্ধ। গাজায় বর্তমানে চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও যথেষ্ট সময়ের জন্য চলতে পারে। এর তিনটি কারণ রয়েছে।

প্রথম কারণ হল, বর্তমান যুদ্ধ ও সংঘাতের জন্য ইসরায়েলের ব্যাপক প্রস্তুতি ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে। যদিও অনেক রিপোর্ট হামাস এবং জিম্মিদের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের উদ্দেশ্যগুলোকে চিহ্নিত করে, এটি গল্পের অংশ মাত্র। হামাসকে ভেঙে ফেলা এবং ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে নেওয়া সমস্ত ইসরায়েলি জিম্মিদের পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি ইসরায়েলের আরও চারটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এই যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হতে পারে তা বিবেচনা করার সময় ইসরায়েলের মতলবগুলো বোঝা দরকার।

চারটি অতিরিক্ত লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে:

  • ১. দীর্ঘমেয়াদে গাজা থেকে কোনও হুমকি নেই তা নিশ্চিত করা,
  • ২. ইসরায়েলি নাগরিকদের নিরাপত্তা জোরদারের নামে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করা,
  • ৩. বেসামরিক নাগরিকদের উপর বারবার হামলার দ্বারা ইসরায়েল কর্তৃক দখলদারিত্বের পরিধি বৃদ্ধি করা, এবং
  • ৪. দক্ষিণ ও উত্তরে সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের বসতিগুলোর বস্তুগত ও মানসিক কাঠামো ভেঙে দখলের পরিসর বাড়িয়ে দেওয়া।

ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধে বা যুদ্ধে সজ্জিত হয়ে থাকতে হবে তার নাগরিকদের সাহস দেওয়ার জন্য। কারণ, ৭ অক্টোবর হামাসের অভিযান ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে। এতে সামরিক বাহিনীর প্রতি নাগরিকদের আস্থা তলানিতে নেমে আসে। ইসরায়েলের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা কাঠামো সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাও ভেঙে যায়। ৭ অক্টোবরের আগে গাজার ঘনিষ্ঠ কিবুটজ বাসিন্দারা তাদের সেনাবাহিনীতে তাদের রক্ষা করার জন্য যে আস্থার অনুভূতি ছিল তা বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কারণ হাজার হাজার হামাস অপারেটিভ তাদের দাপট দেখিয়েছে ইসরায়েলের ঘরে ঢুকে। পরিস্থিতি এতোটাই ভয় ধরিয়ে দিয়েছে যে, আমেরিকা বা ইউরোপের কোনও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে, এমন ইহুদিরা দলে দলে ইসরায়েল ছেড়ে দ্বিতীয় দেশে চলে যাচ্ছে। ভীতি তাদের গ্রাস করেছে। মনোবলো গুড়িয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রতি দেশটির নাগরিকদের আস্থা ও বিশ্বাস সপ্তাহ বা মাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধের মাধ্যমে নৃশংসভাবে ফিলিস্তিনি প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করে ইসরায়েল তার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে চাচ্ছে।

যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত হতে পারে ইসরায়েল ও আমেরিকার যৌথ স্বার্থে। ইরানপন্থী হামাস যেমন ইসরায়েলের পতন চায়, তেমনিভাবে ইরানপন্থী বহু গ্রুপ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার বিদায় দেখতে চায়। হুতি গ্রুপ ইয়ামেন থেকে নিয়মিত আক্রমণ করছে মার্কিন স্থাপনায়। ইরাক ও সিরিয়ায় বিদেশি সৈন্য স্থাপনাও হামলার শিকার। পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে গত সপ্তাহে পাকিস্তান ও ইরান—দুই পক্ষই একে অপরকে না জানিয়ে সীমান্তের ওপারের ‘সন্ত্রাসী’ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। আর এটা এমন সময় ঘটল, যখন গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এ নিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল এখন উত্তাল। ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ নীতির ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে, যার ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার বিপদ আরও তীব্র হবে সামনের দিনগুলোতে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর