চাপ সরছে

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-01-23 11:12:08

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি প্রাথমিক চাপ সামলে নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশিদের, বিশেষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিবিধ বিধিনিষেধের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার কিছুটা সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এখন আগের মতো নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আর আলোচনা নেই। বরং সরকারকে ব্যস্ত থাকতে গেছে বিভিন্ন দেশ ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিনন্দন বার্তা গ্রহণে। অভিনন্দন বার্তা প্রেরণের এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য না থাকলেও আছে জাতিসংঘসহ নানা দেশ ও সংস্থা।

২০১৪ সালের মতো সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনেও অংশ নেয়নি বিএনপি। তবে এবার এক দশক আগের মতো নির্বাচন হয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়নি। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী ছিলেন, সংখ্যার দিক থেকে তা দুই হাজারের কাছাকাছি। সবগুলো সংসদীয় আসনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলেও কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উৎরে সংসদে যেতে পারেননি অনেক সদস্য, মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যও। একাদশ জাতীয় সংসদের অনেকেই এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য মিলিয়ে এবার শতাধিকের জায়গা হয়নি দ্বাদশ সংসদে। এছাড়া নতুন যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে সেখানেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। নতুন মুখের জায়গা হয়েছে, বাদ পড়েছেন পুরনোদের অনেকেই।

আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের সরকারের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় ছিল পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়। এই দুই মন্ত্রণালয়ের তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর জায়গা হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়। কাজে গতি কিংবা নতুন মুখ, নতুন উদ্যমের দেখা পেতেই কিনা এই পরিবর্তন! গতি সঞ্চারের প্রমাণ কি মেলেনি? মনে হয় এর প্রমাণ কিছুটা হলেও মিলেছে, বিশেষ করে নির্বাচনের পর পরই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার অভিনন্দন বার্তা কিংবা স্বীকৃতি।

বেশ ক'মাস ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র(রা) নিয়মিত কথা বলতেন। এখনো বলেন। কিন্তু আগের মতো আর ঝাঁঝাল হয় না সে কথাগুলো। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব অনেক সময় এড়িয়ে যেতেও দেখা যায় তাদের।

নির্বাচনের অব্যবহিত পর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য অভিন্ন ভাষায় বিএনপির ভোটে অংশ না নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের এই দাবির মধ্যে নতুনত্ব ছিল না, ছিল বরং তাদের পূর্বতন কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি। এতদিন নির্বাচন নিয়ে যে ভাষায় তারা কথা বলেছে সেখান থেকে হুট করে ইউ-টার্ন সম্ভব নয় বলেই কি-না তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল ওমন। তবে দেশগুলো বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ যে করবে না সেধরনের কিছু বলেনি, বলবেও না। উপরন্তু নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন সপ্রতিভ, এবং প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যার সচিত্র সংবাদ এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের 'অদ্ভুত' নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে স্বীকৃতি কিংবা অভিনন্দন বার্তা দেয়নি। তবে তারা পুরো পাঁচ বছর, এমনকি এর পর থেকে অদ্যাবধি সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্যে ভিন দেশের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই যদিও, তবে এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার অথবা সৌন্দর্য। ধারণা করা হচ্ছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিনন্দন বার্তা পাঠাবে না আমেরিকা, তবে তারা সরকারের সঙ্গে কাজ করবে না বলেও কোন ঘোষণা দেবে না। গত ক'মাস ধরে যে দূরত্ব এবং টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে দেশ দুটোর মধ্যে সেটা সহসা মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল কিছু আগের মতোই অব্যাহত না থাকার কারণও নেই।

শেখ হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন বার্তা না পেলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরইমধ্যে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কেসি, সার্ক মহাসচিব অভিনন্দন জানিয়েছেন নতুন সরকারপ্রধানকে। ভারত, চীন, রাশিয়া শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। জাপান, তুরস্ক, মিশর, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, এমনকি পাকিস্তানও অভিনন্দন জানিয়েছে নতুন সরকারকে। অভিনন্দন জানিয়েছে ইতালি, চেক প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ, ভুটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিন, মরক্কো, লুক্সেমবার্গসহ আরও অনেকগুলো দেশ। এই এত এত অভিনন্দন বার্তা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের ওপর থেকে চাপ সরার পথ দেখাচ্ছে। এখনই হয়ত পুরোপুরি সরেনি, তবে সরকার এখান থেকে আশাবাদী হয়ে ওঠছে ক্রমশ।

নির্বাচন করতে পারবে না, নির্বাচন করলেও মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবে না, মন্ত্রিসভা গঠন করলেও টিকতে পারবে না আওয়ামী লীগ সরকার—বিবিধ প্রচারণার বিপরীতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্যে সবকিছু ঠিকঠাক। সরকার চাইবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে। নতুন সরকারের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ এখন পর্যন্ত ব্যর্থ নন। দায়িত্ব গ্রহণের সপ্তাহ পেরুতে না পেরুতেই তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট জি-৭৭-এর দক্ষিণ সম্মেলনে (সাউথ সামিট) বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে উগান্ডা সফর করেছেন। বৈশ্বিক ওই সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিবসহ অনেক বিশ্বনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। সাক্ষাতে স্বাভাবিকভাবেই স্থান পেয়েছে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়া, দলটির নেতাকর্মীদের প্রতি সরকারের কঠোর দমননীতি অনেক দিন ধরে বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এনিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পার হলেও তাদের পক্ষ থেকে কঠিন কোন ঘোষণা আসেনি। এ দেশগুলোর বাইরে অন্য অনেক দেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এতে সরকারের ওপর থেকে চাপ সরছে আস্তে-আস্তে।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আবার নির্বাচনের পর তাদের রাষ্ট্রদূত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিলেন। একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তাদের দপ্তরে গিয়ে, শুনিয়েছেন সহযোগিতার কথা। তবু ভিসানীতি-শ্রমনীতি নিয়ে উদ্বেগ শেষ হয়ে যায়নি। কম্বোডিয়া ও নাইজেরিয়ার নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিক বেশ কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন বক্তব্য দিলেও এখনো কঠোর কোন ব্যবস্থার দিকে যায়নি যদিও তারা, তবে এর সময় শেষ হয়ে যায়নি। কিছু ক্ষেত্রে তারা সময় নেয়, কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী ঘটে তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর