গল্পটা একান্তই শরীফ আর শরীফার নয়

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-01-24 15:54:50

সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ বিষয়ে ধারণা দিতে প্রণীত ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে আলোচনায় এসেছেন। মুহূর্তেই ‘ভাইরাল’ হয়েছেন তিনি। তার অদ্ভুত আচরণের প্রভাব পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, বিভক্ত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। কেবল সামাজিক মাধ্যমই নয়, এর প্রভাব পড়েছে সবখানে। বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এনিয়ে বিবৃতি দিতে হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীকেও এনিয়ে কথা বলতে হয়েছে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার রাজধানীতে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আসিফ মাহতাব নামের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন এক শিক্ষক বইয়ের কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে বলেন, ‘বইয়ের দোকানে যাবেন। ৮০ টাকা দিয়ে বইটি কিনে এইযে দুইটা পাতা আছে, শরীফ-শরীফার পাতা দুটি ছিঁড়বেন। ছেঁড়ার পরে আপনারা বইটা দিয়ে বলবেন, বইটা অর্ধেক দামে বেচো।’ বইয়ের পাতা ছিঁড়ে, বই ছেঁড়ার আহবান জানানো আসিফ যে অনুষ্ঠানে ছিলেন সেটা ছিল জাতীয় শিক্ষক ফোরাম নামের একটি সংগঠনের। এরা মূলত চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহযোগী সংগঠন। এবং আসিফ মাহতাব যে অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম।

আসিফ মাহতাবের অভিযোগ ওই অধ্যায়ে ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। তার অভিযোগ, পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডারের নামে ইসলাম নিষিদ্ধ সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এরপর আর যায় কোথায়, যাচাইবাছাই না করে কল্পিত ওই অভিযোগের সপক্ষে অনেককে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অথচ শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রণীত বইটির কোথাও সমকাম ও ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কিছু লেখা নেই। এমনকি শব্দ দুটোর উল্লেখও নেই একবারও। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) উল্লিখিত যে বই সেখানে সমাজের অবহেলিত থার্ড জেন্ডার বা হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কথা বলা হয়েছে, এবং তাদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে এবং তাদের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বইয়ের ওই অংশে সরকার কর্তৃক হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথাটাও বলা হয়েছে। এটা উল্লেখের পেছনে যুক্তিও আছে, কারণ নারী, পুরুষের বাইরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যে অস্তিত্ব ও স্বীকৃতি আছে দেশে সে বিষয় শিক্ষার্থীদের জ্ঞাত করা। তা না হলে স্বীকৃত একটা বিষয় শিক্ষার্থীদের কাছে অজানা থেকে যেত।

তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে সমাজে যে ধারণা প্রচলিত সেটা সুখকর নয়। অনেকেই তাদেরকে মানুষ বলেও মনে করে না। সমাজের মধ্যে অচ্ছুৎ হয়ে থাকা একটা অংশ সম্পর্কে সচেতন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবে তার শিক্ষাক্রমে তাদেরকে পরিচিত করছে এবং সম্মানজনক একটা অবস্থান দিতেও চাইছে। হিজড়াদের মানুষ হিসেবে দেখার যে শিক্ষা সেটা প্রত্যাশিত এবং এ উদ্দেশ্যই এই পাঠের। এখানে আপত্তির কিছু থাকার কথা না, অথচ এটাকেই দেখা হচ্ছে আপত্তির চোখে, এটা নিয়েই হচ্ছে বিতর্ক। ভুল ব্যাখ্যায় করা হচ্ছে বিতর্কিত।

রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার এবং থার্ড জেন্ডার বা হিজড়া যে এক নয় এই শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য। সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইই কেবল নয় শিক্ষক সহায়িকা অংশেও শিক্ষকদের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, এবং সেখানে সচেতনভাবে এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে জ্ঞাত করা হয়েছে।

‘শিক্ষক সহায়িকা’য় বলা হয়েছে—‘জেন্ডার বৈচিত্র্য: জেন্ডার-পরিচয় আমাদের মানসিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ আমরা নিজেরা কী অনুভব করি। মানুষ নিজেকে নারী অথবা পুরুষ হিসেবে যেমন ভাবতে পারে, তেমনি নারী বা পুরুষের যে প্রথাগত ধারণা আছে, তার বাইরে গিয়েও নিজেকে অনুভব করতে পারে; তার শারীরিক লিঙ্গ পরিচয় যেমনই হোক না জেন। জেন্ডারেরও রয়েছে অনেক প্রকরণ। কিন্তু সামাজিক প্রথার ধারণা জেন্ডারের বৈচিত্র্যকে সব সময়ে মেনে নেয় না। তাই একজন মানুষের জেন্ডার-পরিচয় যা-ই হোক না কেন সমাজ আশা করে, প্রতিটি মানুষ সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া অবস্থানে থাকবে এবং সে অনুযায়ী ভূমিকা পালন করবে। অর্থাৎ শারীরিক বৈশিষ্ট্য পুরুষের, সে পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট আচরণ করবে। কিন্তু সমাজের এই বেধে দেওয়া জেন্ডার-ভূমিকা বাস্তবতার সঙ্গে সবসময়ে মেলে না; সমাজে জেন্ডার বৈচিত্র্য আছে। আমরা লিঙ্গ ও জেন্ডার বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়ে, এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করব।’ নারী-পুরুষ ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে শিক্ষকদের বলা হয়েছে—‘লিঙ্গ বৈচিত্র্য: লিঙ্গ হলো আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। আমরা প্রথাগত ধারণায় মনে করি, পৃথিবীতে কেবল দুটো লিঙ্গের মানুষে অস্তিত্ব আছে—নারী এবং পুরুষ। কিন্তু বাস্তবতা হলো XX এবং XY ক্রোমোজমের বাইরেও ক্রোমোজম প্যাটার্ন রয়েছে এবং নারী-পুরুষ ছাড়াও লিঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে। আমরা সেই সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে জেনে নেব। লিঙ্গ বৈচিত্র্য সম্পর্কে কোনো দ্বিধা-সংশয় থাকলে তা কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করব।’ [ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান-শিক্ষক সহায়িকা, পৃষ্ঠা ৭৬, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ]

‘এই সেশনে করণীয়’ সম্পর্কে শিক্ষক সহায়িকায় বলা হয়েছে—‘শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইব, তারা নারী-পুরুষের বাইরে আর কোনো ধরণের মানুষ দেখেছে কিনা। তারা হিজড়া বা এই ধরণের কিছু উত্তর দিতে পারে, নাও দিতে পারে। হিজড়া শব্দটি বললে তাকে জানাব যে, হিজড়া একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির নাম। তারা প্রথাগত সমাজের বাইরে একটি সুনির্দিষ্ট জীবনযাত্রার ধরণ গড়ে তোলে। এই সুনির্দিষ্ট জীবনযাত্রার বাইরের মানুষের লিঙ্গ পরিচয় যা-ই হোক না কেন, সে হিজড়া সংস্কৃতির অংশ না। শিক্ষার্থীরা এই প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমরা শুরুতেই এই আলোচনায় যাব না। এরপরে শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই থেকে শরীফার গল্প পড়তে বলব।’ [ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান-শিক্ষক সহায়িকা, পৃষ্ঠা ৭৭, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ] শিক্ষক সহায়িকার উল্লিখিত অংশে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা ও পাঠে কীভাবে অংশ নিতে হবে তার বর্ণনা হয়েছে। বলা হয়েছে, হিজড়া জনগোষ্ঠীর কয়েকজন সফল মানুষের চিত্র দেখাতে, যা সন্নিবেশ আছে পাঠ্যবইয়ে।

সপ্তম শ্রেণির ‘শরীফার গল্প’ পাঠে এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রূপান্তরকামী এবং সমকাম সম্পর্কে উৎসাহ দেওয়া হয়নি, এমনকি শিক্ষার্থীদের পাঠে এইধরনের কোন শব্দেরও উল্লেখ নেই। শিক্ষক সহায়িকায় শিক্ষকদের বলা হয়েছে পাঠের সময়ে সংবেদনশীল আচরণ করতে। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্পর্কে আলোচনায় শিক্ষার্থীরা এ সম্পর্কে উত্তর না দিতে পারলে আলোচনায় না যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ সতর্ক ও সচেতনতার সঙ্গে এই পাঠে অংশ নিতে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথাগত ধারণার বাইরে লিঙ্গ বৈচিত্র্য সম্পর্কে কোনো দ্বিধা-সংশয় থাকলে তা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ের এই পাঠে যখন এমন সতর্কতা তখন ঠিক এটাকেই পুঁজি করে ফের বিতর্ক তৈরি যে চেষ্টা সেটা নজিরবিহীন নয়। আমরা দেখেছি প্রতিবারই শিক্ষাব্যবস্থা এমন আক্রোশের মুখে পড়ে অনেকের। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই কীভাবে প্রণয়ন হবে সেটা নিয়ে মুখর হয়ে পড়ে এই ধারার বাইরের পৃথক ধারার কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন। এতদিন অপরিচিত থাকা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব এবার সামনে এসেছেন ধর্মভিত্তিক একটা রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে। ওই সংগঠনের অস্তিত্ব যা-ই হোক না কেন, আক্রমণের মুখে যখন পাঠ্যবই এবং যেখানে ধর্মের আশ্রয় সেখানে ফের তৎপর সুযোগসন্ধানীরা।

হ্যাঁ, কথা থাকতে পারে ‘শরীফার গল্প’ পাঠে শরীফ আহমেদ কেন শরীফা আকতার হতে ঘর ছাড়ল। সমঅধিকার, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখাতে শরীফ আহমেদকে ঘর ছাড়া দেখানোর দরকার কি ছিল? ‘শুরু মা’ ছাড়া কি শরীফ অথবা শরীফাদের থাকার জায়গা থাকে না? নিজ ঘর ছেড়ে পৃথক জায়গায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কি তার গত্যন্তর ছিল না? এরমাধ্যমে কি পারিবারিক বন্ধনকে অস্বীকার করা হলো না? এসব নিয়ে আলোচনা করার দরকার ছিল। অর্থাৎ ‘শরীফার গল্প’ গল্পের গল্প-বলায় দরকার ছিল সংবেদনশীলতার পাঠ। আমাদের ধারণা এখানে গল্প বলার ভঙ্গিটা ভিন্ন হতে পারত। এতে প্রকারান্তরে পারিবারিক বন্ধনকে অবমূল্যায়ন হয়েছে যদিও অনেকটা, তবে মানুষে মানুষের ভিন্নতা ও সাদৃশ্য নিরূপণে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে আমাদের মতো মানুষ মনে করে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এটা সুন্দর উদ্যোগ।

আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক চলছে; চলুক। এই সুযোগে যারা ধর্মের যোগ ঘটিয়ে চলেছেন তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আলোচনার এই সময়ে বলতেই হয়—গল্পটা একান্তই শরীফ আর শরীফার নয়; গল্পটা দৃষ্টিভঙ্গির, মানবিক বোধ আর সংবেদনশীলতার। যে যেমন সে তেমনই ব্যাখ্যা করবে, এবং এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর