কালো পতাকা দেখিয়ে ফেরা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-01-27 12:44:22

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির ‘এক দফা’র আন্দোলন শেষ। যথাসময়ে নির্বাচন হয়ে গেছে। বর্জনের নির্বাচন থেকে বিএনপির ‘অর্জন’ কেবল দলের নেতাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং তাদের ভাষায় নির্বাচনে ‘ভোটার অনুপস্থিতি’। এরবাইরে তাদের প্রত্যাশার কিছু ঘটেনি। বিএনপির ধারণা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে সরকারের ওপর এখন পর্যন্ত বিধিনিষেধ আসেনি। আগের মতো আর দৌড়ঝাঁপ নেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের। দলটি অনেকটাই হতাশ পশ্চিমাদের ভূমিকায়।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। মাঠের রাজনীতির সক্রিয় অংশগ্রহণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তাদের। অবশ্য নির্বাচনের আগেও যে মাঠের আন্দোলন সক্রিয় উপস্থিতি ছিল তেমনটাও না, তবে ছিল হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। প্রেস রিলিজ সর্বস্ব হলেও সে আন্দোলন দিয়ে বিএনপি সরকারবিরোধী তাদের কর্মসূচি চালু রেখেছিল, কিন্তু নির্বাচনের পর পরই তারা সবকিছু থেকে দূরে সরে গেছে। নির্বাচনের পর একপ্রকার ‘শীতনিদ্রায়’ দলটি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অপরাপর দলগুলো। এর মধ্যে অবশ্য দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ফিরেছে বিএনপি, দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাড়ে পাঁচ মাস পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন।

‘তালা ভেঙে’ কার্যালয়ে ঢোকার পর বিএনপির নেতাদের এখন ঘরে-বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে। ‘আত্মগোপনে’ চলে যাওয়া নেতারা ফিরছেন জনসমক্ষে। কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির পথ খুলছে। মুক্তি না পেলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিছু মামলায় জামিন পেয়েছেন। মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানীসহ অনেক নেতার জামিনের সম্ভাবনা বেড়েছে। কারাগারে না যাওয়া নেতাদের অনেককে আগের চাইতে বেশি সরব দেখা যাচ্ছে। তারা এখনো আশার বাণী শোনাচ্ছেন কর্মী-সমর্থকদের, নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করছেন।

নেতারা সরব হওয়ার চেষ্টা করলেও সারাদেশের কর্মী-সমর্থকেরা এবারও হতাশ হয়েছেন। সতেরো বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির প্রান্তিক পর্যায়ে নেতাকর্মীরা আরও পাঁচ বছরের অপেক্ষায় চলে গেছেন। বর্জনের নির্বাচন শেষে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তাদের আশাবাদের কথা শোনাতে চেষ্টা করেনি, দেয়নি কোন বার্তা। আন্দোলন কর্মসূচিতে ছেদ পড়ায় দলটির সকল পর্যায়েই নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে হতাশা। তবে হতাশার এই সময়ে দলটি এবার দুইদিনের কর্মসূচি দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার জেলায়-জেলায় এবং আজ শনিবার ঢাকাসহ সকল মহানগরে কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি বিএনপির।

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং সংসদ বাতিলের সঙ্গে একদফা দাবিতে কালো পতাকা মিছিল দিয়ে রাজপথের কর্মসূচিতে ফের ফিরছে বিএনপি। কিন্তু এই ফেরা মোটেও উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। শুক্রবার জেলায়-জেলায় কর্মসূচি থাকলেও এর প্রভাব পড়েনি কোথাও। গণমাধ্যমেও তেমন আলোচিত হয়নি কর্মসূচিটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একপ্রকার নিষ্ক্রিয় দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা। আন্দোলন ও নির্বাচনকেন্দ্রীক হতাশা টের পাওয়া যাচ্ছে সবখানে।

এটা অস্বীকারের উপায় নাই যে, দেড় যুগের কাছাকাছি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সারাদেশে বিএনপির রয়েছে ঈর্ষনীয় রকমের জনসমর্থন। নেতৃত্ব সংকটে দলটি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে ঠিক, তবে জনসমর্থন ধরে রেখেছে। যার প্রমাণ অনেকটাই মিলেছে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ভোটের হার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তথ্যকে সঠিক বলে ধরে নিলেও বলা যায়, দেশের প্রায় ষাট শতাংশ লোক গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচন কমিশন বলেছে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। এরমধ্যে আবার আছে কোন নির্বাচনী এলাকায় মাত্র ১৩.০৪ শতাংশ (ঢাকা-১৫), আবার কোন আসনে ৮৭.২৩ শতাংশ (গোপালগঞ্জ-৩) ভোট। আসন ভেদে কিংবা সামগ্রিক হিসাবে ভোটের এই হার যেমনই হোক না কেন দেশের কোনো আইনেই ন্যূনতম ভোটের বিধিনিষেধ অথবা সীমাবদ্ধতা নেই। তাই ভোটের হার নিয়ে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একপাক্ষিক এবং সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে দেশে যখনই নির্বাচন হয়েছে তখনই ভোটের হার উল্লেখযোগ্য ছিল না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোট পড়েছিল মাত্র ২৬.৫ শতাংশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওটা এমনই নির্বাচন ছিল যেখানে বিএনপি পায় পুরো ৩০০টি আসনই। এরপর একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৪.৯৬ শতাংশ; ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৫.৫৯ শতাংশ; ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ভোট বর্জন করে, এবং ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াসহ মোট ২৩৪টি আসন পায় আওয়ামী লীগ; এবং ভোটদানের হার ছিল ৪০.০৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটদানের হার ৮০.২ শতাংশ। এরআগে, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫.৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ, যখনই নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ছিল না, তখনই ভোটের হার নেমেছে আশঙ্কাজনক হারে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোটের হার নিয়ে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নেতাদের একেক জন একেক সময় একেক কথা বলছেন। কেউ বলছেন, পাঁচ শতাংশও ভোট পড়েনি, কেউ বলছেন ১০-১৫ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া ৪২ শতাংশের হিসাব তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। যদিও কমিশন তাদের নিজেদের বক্তব্যেই তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত ইসি বলেছে কারো আপত্তি থাকলে তারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের পরের দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ভোটের হার নিয়ে বলেছেন, ‘কারো যদি কোনো সন্দেহ, দ্বিধা থাকে, ইউ ক্যান চ্যালেঞ্জ ইট, এবং যদি মনে করেন, এটাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, যে ওটাকে চ্যালেঞ্জ করে, আমাদের অসততা, যদি মনে করেন, তাহলে সেটাকে আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’

ভোটের হার নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা না বিএনপির, সেটা তারা করেওনি। এখানে যুক্তি তাদের যে নির্বাচন বর্জন করেছে তারা সে নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটের হার নিয়ে তাদের ভাবান্তর নেই। অন্যদিকে, তারাই আবার ভোট কম পড়েছে, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি বলে নিজেদের ‘অর্জন’ খুঁজছে।

ভোটের আগে হরতাল-অবরোধ, আর ভোটের পর ঘরোয়া সভা, লিফলেট বিতরণ এবং দোয়া মাহফিল—এসবে সীমাবদ্ধ বিএনপির রাজনীতি। নেতৃত্ব সংকটে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে হয়ে দলটির নেতাকর্মীর মধ্যে যে হতাশা নেমে এসেছে তা থেকে উত্তরণে নির্বাচনের প্রায় তিন সপ্তাহ পর তারা কালো পতাকা মিছিল করেছে। কালো পতাকা মিছিলের দাবিতে আগের মতো আর নেই ‘এক দফা’ দাবি। তাদের এবারের দাবিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ আছে, এটা নিশ্চিতভাবেই গণদাবি। গণদাবি উত্থাপন করেছে এবার তারা, তবে এখানেও ফের জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেনি তারা। সরকারের বাজার অব্যবস্থাপনা আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল মানুষ। এই দাবিতে মাঠে থেকে জনতার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে তারা!

এ সম্পর্কিত আরও খবর