শিক্ষক প্রশিক্ষণে কেন আমরা পিছিয়ে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-09-01 12:41:50

একজন শিক্ষকের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে শ্রেণিকক্ষে আকর্ষণীয় পাঠদান ও মানসম্পন্ন শিক্ষাদান। বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষকতা পেশায় আসার পর পরই শিক্ষকদের বুনিয়াদি কোর্সে অংশগ্রহণ করতে হয়। আমাদের দেশে এটি হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। কিছুদিন যাবত সরকারি কলেজের শিক্ষকদের জন্য এটি চালু হয়েছে কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের যারা শিক্ষার মজবুত ভীত রচনা করবেন তাদের জন্য নেই এই প্রশিক্ষণ। এ যেন অদক্ষ কিংবা আনাড়ি মানুষের হাতে গাড়ি চালাতে দেওয়া।

কী হবে তাতে? বহু নিরীহ পথচারী মারা যাবে এবং গাড়ীচালক নিজেও মারা যাবেন। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় হচ্ছেও তো তাই। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্যার বলতেন, তাদের সময় নাকি প্রাইমারীকে বলা হতো ’প্রায় মরি’ অর্থাৎ মর মর অবস্থা। এখনও কতটা পরিবর্তন হয়েছে? হাঁ, অনেক শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়েছে কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মানে কি তার কোনো প্রভাব পড়েছে? কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই অর্ধেক প্রাথমকি শিক্ষক আমাদের শিশুদের, ভবিষ্যত নাগরিকদের পড়াচ্ছেন।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতি বছর ’ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং (জিইএম) প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রাথমকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। অথচ প্রতিবেশি দেশ নেপাল, মালদ্বীপ, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরে এই হার ৯০ শতাংশেরও বেশি।

এছাড়া শ্রীলংকায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদানরত শিক্ষকদের ৮৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৮২ ও ভারতের ৭০ শতাংশেরই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ রয়েছে। এর বাইরে ভুটান, জর্ডান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষকদের শতভাগই প্রশিক্ষিত। আমরা আসলে কি নিয়ে বড় বড় কথা বলছি?

সংখ্যার তুলনায় প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অপার্যপ্ততাকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবের কারণ বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পর পরই প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। তবে ডিপিই ও সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের আওতায় না আনতে পারলেও নিয়োগ দেওয়ার পর পরই সপ্তাহব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের পাঠদানসহ বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, গুণগত পাঠদানের ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখে না। প্রশিক্ষণ ছাড়া পাঠদান করতে গিয়ে শিক্ষকগণ নানমাত্রায় সমস্যার মধ্যে পড়ছেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা বলছেন, “প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি এক বছর হলো। যোগদানের পরদিন থেকে আমাকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিতে বলা হয়। ক্লাস নিতে গিয়ে আমি বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করি। এরপর প্রধান শিক্ষক ও সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহের বিষয়টি জানাই। তারা আমাকে বলেন, জেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। আপনার সিনিয়ররাই এখানো প্রশিক্ষণ পাননি। তাদের পর প্রশিক্ষণের তালিকায় আপনার নাম আসবে।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ”বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের সনদ নিতে হয়। শুধু প্রাথমিক নয়, শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। নিয়োগের শর্ত হিসেবে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কেননা আমাদের দেশে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়েছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।”

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে সরকারি-বেসরকারি মিলে সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯০১টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার ৩৫০ জন। গড়ে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৯ জন। প্রতি ১১৯৫ জন লোকের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ছাত্র সংখ্যা ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৩৮ ও ছাত্রী সংখ্যা ৮৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩১২। এ শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিয়োজিত ৬ লাখ ২৩ হাজার ৯৬৪ জন শিক্ষক। মোট শিক্ষকের ৬২ শতাংশই নারী। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৮। এই সংখ্যা এবং অনুপাত কিন্তু চমৎকার কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষায় আসলে মানের যে চরম ঘাটতি রয়ে গেছে সেটির কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

ইউনেস্কোর প্রতিবদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকের প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পেছনের সারিতে বাংলাদেশ। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষকদের ৬৬ শতাংশই অপ্রশিক্ষিত। অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদ্যালয়ে পাঠদান করছেন। যদিও পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে এ হার ৯৩ শতাংশ, ব্রুনাইয়ে ৯০ ও নেপালে ৮৯ শতাংশ। আর ভুটান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও জর্ডানে মাধ্যমকি বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানরত শতাভাগ শিক্ষকই প্রশিক্ষিত।

দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এক দশক আগেও মাধ্যমিক পর্যায়ে অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকের চিত্র আরো ভয়াবহ ছিল। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ব্র্যাকসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। এখন শিক্ষা গুণগত মানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আগের তুলনায় অনেক বেশি বরাদ্দ হচ্ছে। তারপরেও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে প্রায় ৪৩ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারছেন না। সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝে প্রশ্নপত্র তৈরিতে সক্ষম ৫৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চলতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৪ হাজার ৮০১টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে এমন একটি চিত্র পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন দল।

১৯৭০ সালে স্কুলে যাওয়ার যোগ্য ২৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যেত না। ২০১৫ সালের এ হিসাব ১৯ শতাংশের নিচে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে প্রাইমারি ও নারী শিক্ষায় লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার যোগ্য ছাত্রছাত্রীর ২০০০ সালের ৮০ শতাংশ ভর্তি হয়েছে এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এগুলো আনন্দের সংবাদ কিন্তু মানের ব্যাপারে কি আমরা এগুতে পেরেছি এই প্রশ্ন এবং উত্তর আমাদেরকেই বের করতে হবে।

বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৯৭২ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে সরকারের কাছে পেশ করা রিপোর্টে সব স্তরে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে ৫ বছরের পরিবর্তে আট বছর মেয়াদি অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তাব করা হয়।

প্রাথমিক স্তরে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে পনের বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। তারপরে আরও কয়েকটি শিক্ষা কমিশন হয় কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন কতটা হয়েছে সে প্রশ্ন আমাদের থেকেই যাচ্ছে।

গ্রাম ও শহরে বসবাসকারী যাদের নূন্যতম সামর্থ্য আছে তারা সন্তানকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ান না। তারা ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাইমারী অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেনে পড়ান। উচ্চশিক্ষায় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিক্রম করতে পারেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া সোনার হরিণ অথচ সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোয় একেবারে ভিন্ন চিত্র।

সরকারি প্রাইমারী স্কুলের সামগ্রিক কাঠামো ও শিক্ষা কার্যক্রমকে এমনভাবে সাজাতে হবে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষই যেন তার সন্তানকে সেখানে পড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সরকারি প্রাইমারী স্কুলগুলোর সামনে অভিভাবকদের কোনো ভীড় নেই। বাচ্চারাও এক একা হেঁটে স্কুলে আসে। অভিভাবকগণ সচরাচর স্কুলে আসেন না। অথচ বিদ্যালয় ও পরিবারের মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করার প্রয়োজন ছিল।

প্রাইমারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা রাষ্ট্র যতটুকু দিয়েছে এখন বাকীটা তাদের অর্জন করতে হবে। তাদের লেখাপড়া, বাচনভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিষ্টাচার ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।

২০১৮ সালের পিইসি পরীক্ষার ফল প্রকাশান্তে এক মন্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বলেন, ‘‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই কিন্ডারগার্টেন আছে, কিন্ডারগার্টেন আমাদের গ্রাস করতে পারবে না। কিন্ডারগার্টেন সরকারি প্রাইমারী স্কুলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকবে না। আসলে হওয়াই উচিতও তাই। সরকারি প্রাইমারীতে চমৎকার ইনফ্রস্টাকচার আছে, আছেন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকমন্ডলী।

তবে, একজন দেখলাম কমেন্ট করেছেন যে, কিন্ডারগার্টেন আছে বলেই পিএসসিতে এতো পাসের হার। সরকারি প্রাইমারী স্কুলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ’খেয়ে দেয়ে তো কাজ নেই, চল প্রাইমারী স্কুলে যাই।’ এটি আসলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রকৃত চিত্র। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। সরকার যদি আরও সচেষ্ট হয়, তাহলে এটি অসম্ভব নয়।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর