যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি বদলাল?

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-02-04 16:52:39

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছিল বিবিধ বিধিনিষেধের শঙ্কা। তবে সব শঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনের ভোটগ্রহণ শেষে নতুন মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করেছে। সদস্যদের শপথের শেষে নতুন সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে, চলবে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে।

নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় অস্থির ছিল কূটনৈতিক অঙ্গন। এটা অনেকটা হস্তক্ষেপ এবং হস্তক্ষেপের চাওয়ার পর্যায়েই ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। এই মেয়াদের মন্ত্রিত্ব না পেলেও আগের দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কূটনীতিকদের সামলেছেন ভালোভাবেই। কূটনীতিকদের বক্তৃতা-বিবৃতি আর দৌড়ঝাঁপের মধ্যেই সীমিত রাখতে পেরেছিলেন তারা। নতুন মন্ত্রিসভায় আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের জায়গা না হলেও তারা তাদের কাজ ঠিকমত করতে পেরেছিলেন।

আগে যেখানে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এখন এই বিরুদ্ধ-সময়ে বিশাল দায়িত্বে একা ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ। আগের মেয়াদে তিনি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। মেয়াদজুড়ে আলোচনার মধ্যে থাকা হাছান মাহমুদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই এরইমধ্যে একাধিক দেশ সফর করে ফেলেছেন। সাক্ষাৎ হয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংস্থাপ্রধানের সঙ্গে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। এরমধ্যে যেমন আছেন আলোচিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, আছেন যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত সারাহ কুক; আছেন বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে অনেক দিন ধরে তৎপর বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। লক্ষণীয় বিষয় হলো তাদের সকলেই মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে গতবছরের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু, পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এনিয়ে নিয়মিত কথা বলে গেছেন। তারা জানিয়েছিলেন, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। নির্বাচনে কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন এবং নাগরিক ও গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় যারা বাধা দেবে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। এরমধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাও আছে বলে জানিয়েছিলেন তারা। নির্দিষ্ট ব্যক্তিই কেবল নয়, ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বলেও জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

ভিসানীতি নিয়ে শুরুতে ভয়ের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ। গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার প্রেক্ষিতে এনিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজসহ সকল মহলে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরব ধারাবাহিক আলোচনা, সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের আমেরিকাবিরোধী অবস্থান ক্রমে ভিসানীতির গুরুত্বকে কমিয়ে দেয়। ভয়ের ভিসানীতি থেকে ভয় কিছুটা দূরীভূত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনেও ভিসানীতি নিয়ে ভয় কেটে যায়। যার কিছুটা প্রকাশ দেখা গেছে সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে।

নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘ভয় দেখাতে’ কিনা দিয়েছিল শ্রমনীতি। ভিসানীতি নিয়ে যে পর্যায়ের আলোচনা হয়েছিল দেশে, সে রকমের আলোচনা এটা নিয়ে হয়নি। এসব নীতি মূলত নানা বিধিনিষেধ, নিষেধাজ্ঞাকে নির্দেশ করে, কিন্তু আলোচনা হয়নি ‘নিষেধাজ্ঞা’ শব্দটি আমাদের কাছে পরিচিত এবং অতি-উচ্চারণে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার কারণে কিনা! একই ধরনের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া স্বভাব-বিরুদ্ধ বলেই হয়ত আমাদের নিয়ে চিন্তাভাবনা কিংবা অনুশীলনের পর্যায়ে এটা ওঠে আসেনি। তবে ভিসানীতি কিংবা শ্রমনীতি দুটোই সরকারকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। দুটো ক্ষেত্রেই সরকার সফল হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে আলোচনাকে ক্রমে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার মাধ্যমে। ভিসানীতি ও শ্রমনীতির সঙ্গে যে রাজনীতি রয়েছে, এবং আমেরিকা ‘নিজেদের স্বার্থে’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না, এই রাজনৈতিক বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে নিজেদের রাজনীতি বাদ দিয়ে আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে বিএনপিও এ ভিসানীতি ও শ্রমনীতির গুরুত্ব কমিয়েছে দেশে।

৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন ভিসানীতি নিয়ে কার্যত আলোচনা নেই, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারবিরোধী অংশের অপেক্ষাও প্রায় শেষ। মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উপস্থিতি আলোচনার খোরাক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়নি ঠিক, কিন্তু মন্ত্রণালয়-মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে আসছেন। এতে বিদেশিদের পক্ষ থেকে সরকারকে অসহযোগিতা করা হবে বলে যে ক্ষীণ-আশা ছিল সরকারবিরোধী অংশের সেটা প্রায় শেষ গেছে।

সহযোগিতার আশ্বাস পেলেও সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মূল্যায়ন কিন্তু বদলায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বলছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাসের দূত পিটার হাসই কেবল নয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এমন কথা নিয়মিত বলা হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি মনে করলেও দেশটি সরকারকে অসহযোগিতা করবে এমনটা মনে করার কারণ নাই। এরআগে ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, নির্বাচনের পর সরকারকে অভিনন্দন বার্তা দেয়নি; তবু তারা পুরো পাঁচ বছর সরকারের সঙ্গে কাজ করে গেছে। এবারের নির্বাচনের পরেও সে একই পথে তারা। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিরোধীদের চলমান দমন-পীড়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের আছে।’

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের মুখপাত্রদের ব্রিফিংয়ে বিএনপির পক্ষে যায় এমন প্রশ্ন করে থাকেন। বৃহস্পতিবার ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সর্বশেষ প্রেসনোটে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী। এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে আছে সন্ত্রাস দমন, সীমান্ত নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত না জানিয়ে বাংলাদেশে নতুন সরকারের সঙ্গে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কাজ করা কীভাবে সম্ভব? জবাবে মিলার বলেন, ‘সারা বিশ্বে আমাদের এ ধরনের সম্পর্ক আছে। আমরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি, ক্র্যাকডাউন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সরকারের সঙ্গে কাজ করার দায়িত্ব আমাদের নেই। উল্লিখিত উভয় ক্ষেত্রেই যেসব বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, সেসব বিষয়ের পাশাপাশি আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সহযোগিতা করতে পারি।’

যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারকে স্বাগত জানায়নি ঠিক, কিন্তু সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশটির অবস্থান বদলেছে। সম্পর্ক এখানে দেশে-দেশে, এটা ব্যক্তি-ব্যক্তিতে নয়। এই কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার অর্থ এই নয় যে, ভিসানীতি নিয়ে শঙ্কা একেবারে কেটে গেছে। মার্কিনীরা ভিসানীতি কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক এবং কিছু ক্ষেত্রে সময় নিয়ে দিয়ে থাকে। কম্বোডিয়া ও নাইজেরিয়ার নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিক কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছর পূর্তিতে দেশটির জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত ২টি কোম্পানি ও ৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি অফিস। সুতরাং সম্পর্কের টানাপড়েন এবং অবস্থান বদলানো নিয়ে এখনই কিছু বলার সুযোগ নাই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর