রাজনীতি বদলে দেওয়ার গণজাগরণ

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-02-05 17:30:58

৫ ফেব্রুয়ারি; গণজাগরণ দিবস। ২০১৩ সালের এই দিনে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শুরু হয় গণজাগরণ আন্দোলনের। এ আন্দোলনের পথ ধরে রচিত হয়েছে কলঙ্কমোচনের সোনালী সিঁড়ি। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের পর আপিলের সুযোগ সৃষ্টিতে ন্যায়বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। এই আন্দোলনের পথ ধরে একুশ শতকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশবিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তির উত্থানের পথে প্রতিবন্ধক রচিত হয়। কোণঠাসা হতে শুরু করে দেশবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো।

বিশ-তেরোর সেই গণজাগরণ শহিদ জননী জাহানারা ইমামের গণআন্দোলনের চেতনা থেকে উৎসারিত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন একদিনের অর্জন নয়। শহিদ জননীর দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে ব্লগারেরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের লেখালেখির মাধ্যমে অনলাইন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল। অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একটা প্রজন্ম গড়ে ওঠেছিল যারা একাত্তরের গণহত্যার পরিকল্পনাকারী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটির সদস্য এবং তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছিল। এই প্রজন্মের সবাই যে অনলাইনে গবেষণা কিংবা লেখালেখি করেছিল তা নয়, তাদের লেখালেখিতে প্রভাবিত বিপুল সংখ্যার একটা শ্রেণির নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ছিল; যাদের অনেকেই দেখেনি জাহানারা ইমামের সে আন্দোলন; তবু বুকে ধারণ করে ছিল সে চেতনা।

একাত্তরের গণযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ধর্মভিত্তিক দল সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানিদের গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল। ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখের বেশি নারীর অসম্মান ঘটেছিল তাদের সম্মিলিত আক্রোশে। সেই দেশবিরোধীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতা এবং ক্ষমতার আশপাশে ছিল। দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল ব্রাত্য তাদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ বলতেই নির্দিষ্ট তরঙ্গের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের একটা ঘোষণা পাঠ, যাকে তারা ঘোষণা বলে দাবি করত, সেটাই ছিল কেবল। মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকেরা দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, আবদুল আলীমকে করেছিলেন মন্ত্রী। আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে করেছিলেন মন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে করেছিলেন মন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী একাধিকবার হয়েছেন সংসদ সদস্য। এছাড়াও আরও আছেন অনেক, যারা জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন।

দেশবিরোধীরা ক্ষমতায় গেছে, ক্ষমতায় কাছাকাছি থেকেছে, তবু একাত্তরে তাদের ভূমিকা-গণহত্যা ভুলে যায়নি দেশের মানুষ। রাজাকারদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে দাঁতে দাঁত চেপে হয়ত সহ্য করা হয়েছে কিন্তু আখেরে এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে অবিনাশী। মানুষ যখনই সুযোগ পেয়েছে, ডাক শুনেছে তখনই সাড়া দিয়ে দেশবিরোধীদের প্রতি জানিয়ে গেছে তাদের প্রবল ঘৃণা। সাংগঠনিকভাবে হোক আর ব্যক্তি পর্যায়েই হোক প্রবল ঘৃণাকে আগলে রেখে অপেক্ষায় ছিল প্রতিবাদী কোনো ডাকের।

যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রকাশের উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদের পেছন খুঁজতে গেলে উল্লেখ করতে হয় তেমন কিছু ঘটনা। একাত্তরের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রধানতম সাইন বোর্ড গোলাম আজম বাংলাদেশে আসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে। পাকিস্তানি এই নাগরিক তার অসুস্থ মাকে দেখতে আসার নামে বাংলাদেশে আসে। প্রতিবাদ করার জন্যে খুব বেশি লোক ছিল না। তবু এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূর-উজ্জামানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার এই আগমনের জোরালো প্রতিবাদ করেন।

শহিদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করে। একটা দলের প্রধান কে হবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় থাকলেও যখনই একজন পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান করা হয়, তখনই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সুধীসমাজ। জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২, ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়।

কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আজমের ঐতিহাসিক প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয়। গণআদালতে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী এবং জাহানারা ইমামকে নিয়ে ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের রায়ে গোলাম আজমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। গণআদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে রায় ঘোষণা করেন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এবং একই সঙ্গে তিনি গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবিও জানান।

গণআদালতের এই রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে লাখো জনতার পদযাত্রা জাতীয় সংসদের স্পিকার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারকলিপি দেয়। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। ওখানেই থেমে থাকেননি শহিদ জননী। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বেগবান করেন, জনসমর্থন পায় এই আন্দোলন। কিন্তু রায় কার্যকর না করে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আট শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়; যার মধ্যে ছিল আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা।

ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জাহানারা ইমামের মৃত্যু, এরপরের নেতৃত্বহীনতা ও বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন প্রায় হারিয়ে যায়। মাঠের আন্দোলন হারালেও অনলাইনের আন্দোলন হারিয়ে যায়নি। গড়ে ওঠে এমন এক প্রজন্ম, যারা একাত্তরকে ধারণ করে। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এই আন্দোলন আবারও মাঠে আবির্ভূত হয় 'মিরপুরের কসাই' খ্যাত আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের পর। মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে দেশ, সৃষ্টি হয় গণজাগরণের।

তেরোর সেই গণজাগরণ আদতে একুশে শতকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাকেই বদলে দেয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের ঘৃণা করার অপ্রকাশ্য আকুতিকে প্রকাশ্য করে দেয়। মানুষ প্রকাশ্যে জামায়াতের রাজনীতি এবং জামায়াতের আর্থিকখাত সম্পর্কে অবহিত হয়। বর্জনের ডাক আসে, এবং মানুষ বর্জন করতে শুরু করে। একাত্তরে জামায়াতের প্রকৃত রূপ ও ইতিহাস এই সময়ের মানুষদের কাছে প্রকাশ্য হওয়ার পর তারা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথ দেখতে শুরু করে। তেরোর সেই গণজাগরণ জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করেছিল। সেখান থেকে আর বেরুতে পারেনি দেশবিরোধী এই রাজনৈতিক দলটি।

গণজাগরণ আন্দোলনের একটা অন্যতম দাবি ছিল, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এনিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি ঠিক, কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রো-একাত্তরের চেতনায় জামায়াতের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে। তেরোর সেই ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি তারা। তাই এই সময়েও মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের গৌরবময় অনেক ঘটনার অপ্রকাশ্য বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ-তেরোর গণজাগরণেরও বিরোধিতা করে তারা। একাত্তরের পরাজয়ের সঙ্গে তেরোর সেই পরাজয় ক্ষত হয়ে এখনও বিঁধে তাদের।

বিশ-তেরো আমাদের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সুফল এখন ভোগ করছে দেশ। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে একটা প্রজন্ম চুপিসারে গড়ে ওঠলেও তাদের আদর্শকে ঘৃণা করে দেশের অধিকাংশ মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকার এখন প্রকাশ্যে গণজাগরণ আন্দোলনের অবদানকে স্বীকার না করলেও এর সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী তারাই।

গণজাগরণ আন্দোলনের আজ ত্রয়োদশ বার্ষিকী। আন্দোলনের তেরো বছরে অর্জন কী; উত্তর সম্ভবত—একাত্তরের মানবতাবিরোধী বেশ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর এবং দেশবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে দেওয়া! একুশ শতকের এটাই বোধ করি বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর গণআন্দোলন, বাংলাদেশের রাজনীতির পথ নির্দেশ করে দেওয়া গণজাগরণ!

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম। ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর