বঙ্গবন্ধুর ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন’ আইন বাস্তবায়ন কতদূর!

, যুক্তিতর্ক

আসাদুল হক খোকন | 2024-02-20 20:37:26

কিভাবে বাংলা আমাদের সকলের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হলো তার ইতিহাস কম বেশি সকলেরই জানা। তবে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সবার জানা নেই তা হলো- বর্তমানে মাতৃভাষাভাষি মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় ‘বাংলা’ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। আর মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান সপ্তম। এছাড়া বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এটিই বিশ্বের একমাত্র ভাষার আসন দখল করে নিয়েছে। যা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের সকলের গৌরব।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ৯৮.৯% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এবং বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরের অধিক পুরনো। গত সহস্রাব্দির সূচনালগ্নে পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। সুলতানি আমলে অত্র অঞ্চলের অন্যতম রাজভাষা ছিল বাংলা। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী বাংলার নবজাগরণে ও বাংলার সাংস্কৃতিক বিবিধতাকে এক সূত্রে গ্রন্থনেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসকল দিক বিচার করলে সহজেই অনুমেয়, ভাষা হিসেবে বাংলা কতটা সমৃদ্ধ।

এবার বাংলা ভাষার গোড়ার দিকে কিছুটা দৃষ্টি দেয়া যাক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বাংলা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হয়। এর ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিবিধ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মৃতি ধরে রাখতে নির্মিত হয় ঢাকা মেডিকাল কলেজের পাশে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তিত হয় ‘বাংলা’।

১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সরকারি অফিস-আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। সে আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষাপ্রচলন আইন জারি করে। ওই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’

এর দীর্ঘ ২৭ বছর পর ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেন। সব রকম নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলেন।

আদালতের আদেশের তিন মাস পর একই বছর ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলা হয়। সে আদেশ প্রায় অনেকাংশে বাস্তবায়ন হলেও অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশে রোলের নিস্পত্তি হয়নি। বিচার বিভাগ অর্থাৎ আইন ও আদালত মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। আদালতের অধিকাংশ রায় বাংলায় দেওয়া হলেও উচ্চ আদালত আইন এবং রেফারেন্সের দোহাই দিয়ে অধিকাংশ রায়ই ইংরেজিতে দেওয়া হচ্ছে। যদিও উচ্চ আদালতের কয়েকজন বরেণ্য বিচারপতি বাংলায় রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন ও গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষা শিখতে হবে। বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে পরাক্রমশালী দেশ চীন, জাপান, কিউবাসহ অনেক দেশই নিজেদের ভাষার মাধ্যমেই দেশকে সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে নিয়ে গেছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর বিদেশি ভাষার পত্তন।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করেননি, বরং তার রচিত বাংলা সাহিত্যকেই ইংরেজিতে অনূদিত করা হয়েছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা বাংলাভাষী হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারি না, বরং দু-এক বাক্য ইংরেজি জানলেই নিজেদেরকে স্মার্ট ভাবতে শুরু করি। অন্যদিকে বাংলায় পড়া বা বাংলা জানা মানুষ ইংরেজি জানা মানুষদের সামনে গেলে হীনমন্যতায় ভোগেন। নিজের মায়ের ভাষাকে কণ্ঠে ধারণ করে মাথা উচু করে বলতে পারেন না- বাংলা আমার মাতৃভাষা, নিজের ভাষাকে বাদ দিয়ে যারা অন্যের ভাষাকে অন্তরে ধারণ করেন তারা দেশদ্রোহীর তুল্য! সারা দুনিয়া বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় আদেশ থাকা সত্বেও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। নিশ্চিত করা যায়নি দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই ক্ষেত্র চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রযুক্তি শিক্ষায় পাঠ ও নির্দেশনা বইগুলোর বাংলা অনুবাদও!

সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গোড়াতে হাত দিতে হবে। আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো শিক্ষাক্ষেত্র। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। তাই তাদের যদি শৈশব থেকেই ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করা যায়, তাহলে তারা পরবর্তী কর্মজীবনেও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সক্রিয় থাকবে। আস্তে আস্তে মাতৃ ভাষানুরাগী একটি জাতি গড়ে উঠবে। ভবিষ্যতে কোনো ইংরেজি স্কুলের শিক্ষার্থী যাতে বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীকে ছোট করে না দেখে। না ভাবে, বাংলা একটি নিম্ন মানের ভাষা, নিম্ন মানের মানুষের ছেলে মেয়েরা বাংলায় পড়ে!

প্রশ্ন হতে পারে, সবকিছু কেন বাংলাকেন্দ্রিক হতে হবে? এর উত্তর- বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় যখন কিছু বলা হয় বা প্রচার করা হয় তখন খুব সহজেই সমাজের যেকোন প্রান্তে থাকা মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়। বিজাতীয় ভাষায় যোগাযোগ করা হলে সেখানে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ভাষার সারল্য ও বোধগম্যতা। আপনি কোনো বক্তব্য যখন একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে চান তখন তার মাধ্যম যদি ওই জনগোষ্ঠীর নিজের ভাষা না হয় তবে তা কখনো সফল হবে না।

এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ সব চেয়ে নিরাপদে হেটে চলেছে। দিনের পর দিন নানা কুসংস্কার আচ্ছন্ন জাতিকে সংস্কার করে বৈশ্বিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামিল করা হয়েছে। নানামুখি উন্নয়ন কর্মকান্ড দৃশ্যমান হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধুর সেই আদেশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে আশা করি, অচিরেই বিশেষ করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল কর্মক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি নয় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি চালুর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

এটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের অন্তরে এই কষ্ট আর থাকবে না যে, দুঃখ করে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

লেখক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর