সম্পর্কের নতুন মাত্রা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-02-26 21:03:11

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে কালমেঘের দেখা গিয়েছিল, তার অনেকটাই সরে গেছে। নির্বাচন হয়েছে। অনুমিত আশঙ্কার বিবিধ নিষেধাজ্ঞা আসেনি বাংলাদেশের ওপর। ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আলোচনা, শ্রমনীতি নিয়ে যে শঙ্কা তার প্রভাব কাটতে শুরু করেছে। নিষেধাজ্ঞার আলোচনা অনেকটাই মিলিয়ে গেছে, বরং পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ক আলোচনাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। ‘সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার’ বার্তা ধ্বনিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, এর কিছু লক্ষণেরও দেখা মিলছে।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন শেষে নতুন সরকার পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। প্রায় 'মুখোমুখি' থাকা দূতাবাস ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব কমে এসেছে। মুখোমুখি অবস্থান বলছি যদিও, বাস্তবিক অর্থে এর সুযোগ সীমিত। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অতি-আগ্রহ, মিডিয়ায় গুরুত্ব পাওয়া এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মার্কিন দূতাবাসের দৌড়ঝাঁপের যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছিল তাতে মুখোমুখি শব্দের ব্যবহার অত্যুক্তি নয়। সেই অবস্থার সমাপন হয়েছে অনেকটাই। এখন আমেরিকার সঙ্গে সরকারের দূরত্ব ঠিক আগের মতো মনে হচ্ছে না।

আমেরিকা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেনি। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সরকারের দমননীতির সমালোচনা করেছে। নতুন সরকারকে আনুষ্ঠানিক বার্তায় অভিনন্দন জানায়নি। তবে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে না বলে কোনো মন্তব্য করেনি। অভিনন্দন না জানালেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে জো বাইডেন 'বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয়' ব্যক্ত করেছেন।

বাইডেন লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র–বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি তুলে ধরছি।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট দুই দেশের সম্পর্ককে সহযোগিতা ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস রয়েছে। আর আমাদের এই সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক।’

বাইডেনের এই চিঠি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আশঙ্কা, সরকারবিরোধী অংশের যে প্রত্যাশা তাতে জল ঢেলে দিয়েছে। চিঠিতে অভিনন্দন নাই সত্য, তবে এখানে কাজ করার যে অঙ্গীকার সেটাই মূলত সরকারের অর্জন এবং আগামীর পাথেয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জো বাইডেনের এই চিঠিই কেবল নয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দল। এতে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ সহকারী ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর এলিন লাউবাকের, ইউএসএআইডির এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মাইকেল শিফার এবং ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তার।

ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, প্রতিনিধি দলটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পারস্পরিক স্বার্থের অগ্রগতির জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করবে। সফরকালে তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজ, শ্রম সংগঠক এবং মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠক করবে।

প্রতিনিধি দলের প্রধান এলিন লাউবাকের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘কীভাবে আমাদের সম্পর্ক আরও গভীরতর করতে পারি এবং সম্পর্কের নতুন যুগ কীভাবে শক্তিশালী করতে পারি, সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি। তারাও আমাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে চায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, নতুন অধ্যায়ে সম্পর্ক শুরু হোক। আমরাও চাই সম্পর্কে একটা নতুন অধ্যায় শুরু করতে। যেহেতু দুই দেশের ইচ্ছে আছে, এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, গভীরতর উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের উভয় দেশ উপকৃত হবে।’ অর্থাৎ বিদ্যমান অবিশ্বাসের বিপরীতে সম্পর্ককে আরও গভীর করাই এই সফরের উদ্দেশ্য।

মার্কিন প্রতিনিধি দলের এই সফরটি যদিও নির্বাচন এবং জো বাইডেনের চিঠির পরে নির্ধারিত হয়নি। এটা হয়েছে নির্বাচনের দুই মাস আগে, গত অক্টোবরে। তবে প্রতিনিধি দলের এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠির প্রভাব যে রয়েছে তা নিঃসন্দেহ। নির্বাচনের পর বাইডেনের চিঠি না এলে সফরে তাদের কার্যসূচিও অন্যরকম হয়ে পারত বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে, সেখানেও একই কথা উচ্চারিত হয়েছে; সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া। এই সাক্ষাতে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।

সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর করতে চাই এবং নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাই। বাংলাদেশ সফররত প্রতিনিধিদলও একই কথা বলেছেন। নির্বাচন এখন পেছনের ঘটনা। সেটা নিয়ে তারা কোনো কথা বলেনি, আমরাও বলিনি।’

ঢাকা সফররত মার্কিন এ প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের সাক্ষাৎ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সরকার, নির্বাচন ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সাক্ষাৎ শেষে এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, 'তারা আমাদেরকে ইনভাইট করেছে, আমরা এসেছি, কথাবার্তা বলেছি।' নির্বাচন নিয়ে কী কথা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেছেন, 'কিছু বলার নাই'। বিএনপি নেতাদের হতাশার ভাব এখানে স্পষ্ট। বৈঠকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূত পিটার হাসও উপস্থিত ছিলেন।

জো বাইডেনের চিঠি, মার্কিন প্রতিনিধি দলের 'সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা' এবং বিএনপি নেতাদের 'কিছু বলার নাই' মন্তব্য বলছে- যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সরকারের যে অস্বস্তি কিংবা আশঙ্কা সেটা অনেকটাই কমে আসছে। এই সফর দেশ দুটোকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসার বার্তা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ভিসা নিষেধাজ্ঞা, শ্রমনীতি নিয়ে শঙ্কাসহ বিবিধ নিষেধাজ্ঞা থেকে সরকারকে অনেকটা স্বস্তি দিচ্ছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী অংশকে অনেকটাই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর