বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র: চল্লিশ বছরের পথচলা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-23 15:57:26

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর তখন বেশ খারাপ। তবু পারস্যরাজের অনুরোধে তিনি সেদেশ ভ্রমণে রাজি হলেন। সত্তর বছর বয়সে সেই ভ্রমণই ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বিদেশ ভ্রমণ। ১৯৩২ সালের এই ইরান-ইরাক ভ্রমণ নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘পারস্যে’ শিরোনামে।

সেই সফরের অভিজ্ঞতার এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মনে পড়ছে ইরাকে একজন সম্মানযোগ্য সম্ভ্রান্ত লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ইংরেজ জাত সম্পর্কে আপনার কী বিচার?’ আমি বললেম, ‘তাঁদের মধ্যে যাঁরা নবং: তাঁরা মানবজাতির মধ্যে নবং:।’

তিনি একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর যারা হবীঃ নবং:? চুপ করে রইলুম। উত্তর দিতে হলে অসংযত ভাষার আশঙ্কা ছিল। এশিয়ার অধিকাংশ কারবার এই হবীঃ নবং:- এর সঙ্গেই। তাদের সংখ্যা বেশি, তাদের স্মৃতি বহু ব্যাপক লোকের মনের মধ্যে চিরমুদ্রিত হয়ে থাকে।’

রবীন্দ্রনাথের ভাবনাজাত এই নেক্স-বেস্ট লোকরাই আমাদের জীবন দখল করে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ এদের হাতেই ন্যস্ত। তাই কাঙ্ক্ষিত মানের দেশ এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

আমাদের রাজনীতিতে যে হতাশা, আমাদের রাষ্ট্রাচারে যে দুর্গতি, আমাদের সমাজজুড়ে যে দুঃখ নিত্যদিন আমাদের বেদনাকে বাড়িয়েই চলেছে, তা হচ্ছে সর্বত্র আমাদের মূল্যবোধ সম্পন্ন, বেদনাজাগ্রত মানুষের অভাব।

জাতির বিদ্যায়তন, শিক্ষায়তন সেই মানসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হয় নাই। আমাদের শিক্ষাধারায় অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয়েছে কিন্তু বড় জাতি তৈরি করতে হলে যে বড় মানুষ দরকার, সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষ তৈরির কোনো পথ এখনো বের করা সম্ভব হয় নি।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাজাত বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে তো সেই বৈভবসম্পন্ন, চিত্তের আলোকায়নঋদ্ধ মানুষ চাই-ই চাই।

সম্ভবত এই বেদনা বাংলাদেশের একজন শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে খুব তাড়া করেছিল। তিনি তাই ‘আলোকিত মানুষ চাই’-এই শ্লোগানমগ্ন এক প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 খুব ছোট আকারে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজ বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। দেশে-বিদেশে তার ব্যাপকতর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজারো শিক্ষার্থি এই প্রতিষ্ঠানের নানারকম মননশীল কর্মসূচির অংশীজন হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা দেখতে দেখতে এই প্রতিষ্ঠান তার প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরও পার করে ফেলেছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঘটা করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চল্লিশ বৎসর পূর্তি উৎসব পালিত হবে।

দুই.

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এই দেশে তার চল্লিশ বছর পার করে ফেলেছে এইটা বড় কম কথা নয়। শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনেছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবুসায়ীদ এক অপার বেদনায়। অনেকটা ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়েই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই শিক্ষকতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই এই প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন।

আমাদের আমজনতার ব্যক্তিজীবনে বা পেশাজীবনে কোনো ক্ষোভ বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এক ধরণের ক্ষুব্ধতা আর অসহায়ত্ব নিয়েই আমাদের দিন কাটে। কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটলো সেই বেদনার কারণ চিহ্নিত করে তা উপশমের চেষ্টা আমরা করি না। সেটা আমজনতার কাজও নয়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জাত শিক্ষক। তাঁর  শিক্ষাজীবনের বেদনা তাঁকে এই ক্ষত নিরাময়ের কারণ অনুসন্ধান ও সেই দুঃখ জয়ের কাজে ঠেলেছে অন্ধ আবেগ দিয়েই। শিক্ষক জীবনে দেশের সেরা বিদ্যায়তন ঢাকা কলেজেই তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছেন নৈরাজ্যকর ছাত্র রাজনীতির, দেখেছেন বিদ্যায়তন ছেড়ে শিক্ষার্থিরা কিভাবে ছুটে গেছে প্রাইভেট টিউটরের বাসায়।

শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অধোগতি তার ভেতরটাকে কুরে কুরে খেয়েছে। তিনি তাঁর শিক্ষক জীবনের আত্মস্মৃতি ‘নিস্ফলা মাঠের কৃষক’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সবাই যখন নিজের স্বার্থের ছোট্ট একান্ত কুঠুরির খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছে তখন আমি কেন একা কষ্টে ছিন্নভিন্ন হচ্ছি। সারা জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একা এই নিস্ফলাপ্রান্তরে আমি কতটুকু কী করতে পারব?’

‘সত্যি যদি তাদের জন্য অর্থপূর্ণ কিছু করতেই হয় তবে তা এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আর সম্ভব নয়। এই বৈষয়িক প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, রুটিরুজির স্বার্থসংশ্লিষ্ট আবিল জগতের মধ্যে তার ভবিষ্যত সম্ভব নয়।  তা যদি করতে হয় তবে তার জন্যে যেতে হবে ‘অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।’ শিক্ষাঙ্গনের দেয়াল-ঘেরা এই অবসিত প্রান্তরে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।’

তিন.

সেই উত্তর খুঁজতে পথে নেমেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। মানুষের ভেতরের যে উজ্জ্বলতর দিক, যা তার বৈষয়িক স্বার্থান্ধ দিকের চাইতেও শক্তিমান সেই আলোকিতদিকটিকেই ভরসা ভেবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজে নিরন্তর ছুটে চলেছেন সায়ীদ স্যার।

তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের কথাতেই আস্থাশীল। রবীন্দ্রনাথ মানুষের কাজ, মানুষের ধর্মকে যেভাবে দেখেছেন সেই আলোকময় দিকটিই হয়তো অধ্যাপক সায়ীদের এই অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজে উৎসাহ যুগিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মানুষেরএকটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে আপন ব্যাক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানেসে জীবরুপে বাঁচতে চায়। কিন্তু মানুষের আর-একটা দিক আছে যা এই ব্যাক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে।

সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্যে বস্তু-সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশি। সেখানে জ্ঞান উপস্থিত-প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে। সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়োজীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।

স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’

চার.

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাই হয়তো ভাবে, বড় মানুষ, সম্পন্ন মানুষেরাই শুধু পারে একটি বড় দেশ আর বড় জাতিকে গড়ে তুলতে। আমাদের সম্মুখে আগামী দিনের যে-মহান বাংলাদেশ অপেক্ষমাণ তার সুযোগ্য নির্মাণের জন্য আজ আমাদের প্রয়োজন অনেক সমৃদ্ধ মানুষের। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মনে করে আগামী দিনের সম্পন্ন বাংলাদেশকে গড়ে-তোলার পূর্বশর্ত হিসেবে আজ ঐসব মানুষের গড়ে তোলা আমাদের জন্য অপরিহার্য; সেই সব মানুষ, যাঁরা উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত, শক্তিমান, কার্যকর এবং সংশপ্তক।

পাঁচ.

আমরাও সায়ীদ স্যারের এই আশাবাদের সাথে একমত। জাতির নিজের প্রয়োজনেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে চালিত করা আমাদেরই কাজ।এই প্রতিষ্ঠান শতায়ু হোক। তার যাত্রাপথের সকল বাধা দূর হোক। চল্লিশ বছরপূর্তি উৎসব সাফল্যের সাথে শেষ হোক। সকল দল-মত-পথের মানুষের চিত্তের আলোকায়নের উৎসভূমি হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাক-এই শুভ কামনা নিয়েই লেখাটি শেষ করছি।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর