বাংলাদেশের সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আজও শোক বিহ্বল সাদি মহম্মদের আত্মহননের ঘটনায়। যারা মানুষকে জীবনের জয়গাঁথা শুনিয়ে থাকেন, জীবনের অর্থ তুলে ধরেন, যাদের গান শুনে আমরা সাধারণ মানুষেরা লড়াই করার শক্তি খুঁজে পাই, অনুপ্রেরণা পাই ঘুরে দাঁড়াতে, তাঁদের একজন যদি আত্মহননের পথ বেছে নেন তখন সেটি মর্মে বাজে বৈকি।
আমাদের দেশে প্রতিদিন নানা কারণে বহুজন আত্মহত্যা করে থাকেন। কেউ দারিদ্রতার কারণে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কেউবা সম্ভ্রম হারিয়ে আর কেউ স্বামী বা স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। এই মৃত্যু সুখের নয়। যদিও মৃত্যু হলো জীবনের শেষ অঙ্ক। সবাই সেটি জানি। কিন্তু কোনো মৃত্যুই তার স্বজনরা মেনে নিতে পারেন না। তবে প্রথিতযশা রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যা জাতির বৃহৎ এক অংশকে বিমুঢ় করে দিয়েছে।
সাদি কেন এই পথ বেছে নিয়েছেন, কেন তাঁর জীবনের প্রতি অনীহা জম্মালো এই নিয়ে সাদির পরিবার এবং তাঁর বন্ধু স্বজনরা নানারকমভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আত্মহত্যা করার পরেও ইসলাম ধর্মের অনুসারী অনেকে স্রষ্টার কাছে তাঁর জান্নাতবাসের জন্য প্রার্থনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় সাদিকে তাঁরা কতটা ভালোবাসতেন।
সাদি মহম্মদ একজন শহিদের সন্তান। স্বচক্ষে দেখেছেন কীভাবে তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে বিহারিরা। একই দিনে তাঁর এক খালাতো ভাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। সেই নৃশংস দৃশ্য সাদিকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাড়া করেছে, এটি আর কেউ না বুঝুক শহিদ পরিবারের সদস্যরা অনুভব করেন প্রতিনিয়ত। এই শহিদজায়াদের অবর্ণনীয় কষ্ট বা যুদ্ধের খবর কেউ রাখেনি। রাখেনি রাষ্ট্র। বিশেষ করে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। সাদিকে প্রতিনিয়ত সেই দৃশ্য এবং পরবর্তীতে ওঁর মায়ের যুদ্ধ কুড়ে কুড়ে খেত। তবে এটাও কী যথেষ্ট কারণ হতে পারে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে সাদি মহম্মদের মতো একজন পরিশীলিত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পীর পক্ষে, যিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে।
বিভিন্নজনের লেখা পড়ে বা সাক্ষাৎকার দেখে আমার দু' একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। তার একটা হলো একজন শিল্পী বলেছেন (অভিযোগ শব্দটা প্রয়োগ করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না) সাদি মহম্মদকে অনেকে অপমান করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁদের ক্ষমা করে দিতেন সবসময়। তাহলে দাঁড়াচ্ছে রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা করার পরেও সবার মন যে একই মানের থাকে তা নয়। আমার অবশ্য জানা নেই সাদি ঠিক কাদের আচরণে কষ্ট পেয়েছিলেন? যিনি বলেছেন তিনি তো জানতেন বিষয়গুলো। প্রতিবাদ করেছিলেন? অন্যের কাছে অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে আমরা অনেকসময় চোখের সামনে কেউ অন্যায় আচরণ করছেন বুঝেও চুপচাপ দেখে যাই।
আর একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে তাহলো সাদির অনুজ শিবলীর কান্নাজড়িত কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে। ভাই কষ্ট পাবে দেখে শিবলী তার পুরষ্কার লুকিয়ে রাখতেন। এটা ঠিক কাজের স্বীকৃতি সবাই চায়। তবে আমার ধারণা ছিল সাদিদের মতো শিল্পীরা মনের আনন্দে গান করে থাকেন। তাঁরা কিছুর প্রত্যাশা করেন না। আমি এখনও বিশ্বাস করতে চাই সাদী সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতির অপেক্ষায় ছিলেন না। যদিও তাঁর পরিবার থেকে এই কথাও উচ্চারিত হয়েছে মানব পাচারকারী শিল্পী পদক পেতে পারেন ... কথাটি আমলে নিলে সাদি মহম্মদ হয়তো বা কখনও তাঁর আপনজনের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন।
এই জায়গায় আমি হোঁচট খেলাম। সাদি রবীন্দ্রনাথের গানের সুর তাঁর কন্ঠে ধারণ করেছিলেন। গুরুদেবের গানের বাণী মুখস্থ করে নিয়েছিলেন। অনেক বছর আগে পড়েছিলাম কোনো এক সাপ্তাহিকীতে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সাদি তাঁর শিক্ষকদের নজর কেড়েছিলেন তাঁর অসাধারণ মনে রাখার ক্ষমতা এবং খুব তাড়াতাড়ি সুর ধরে ফেলার প্রতিভায়। রবীন্দ্রনাথ যত শোক পেয়েছিলেন তাঁর প্রথম জীবনে, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি থেমে থাকেনি। দশটি বছর যখন তিনি শিলাইদহে ছিলেন, আমার দৃষ্টিতে ওটা ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনীর তো বটেই। রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো শ্রেষ্ঠ রচনা রচিত হয়েছিল শিলাইদহে থাকাকালীন।
১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। দুর্ভাগ্যবশত ১৯০২ সালে মৃণালিনী দেবী মারা যান। তার মাস কয়েক পরে মারা যান রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা রেনুকা। ১৯০৩ সালে। ১৯০৭ সালে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির বন্ধুর বাড়ি মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দশ এগারো বছরের বালক শমীন্দ্রনাথের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছায়া দেখেছিলেন। শমীর মৃত্যুর পরে কবি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও তাঁর সৃষ্টি থেমে থাকেনি। তাঁর সাহিত্যচর্চা নিয়মিতই চলতে লাগলো। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে কবি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেকগুলো বিখ্যাত গান রচনা করেছিলেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। ভারতীয় উপমহাদেশ, যার একটা অংশ অবিভক্ত বাংলা, তখনও বৃটিশ সাম্রাজ্যের কলোনি।
রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টানলাম এইজন্য যে কবি এতগুলো শোক অন্তরে বয়ে নিয়ে চললেও তাঁর কোনো কাজে শিথিলতা আসেনি। মৃণালিনীর মৃত্যুর পরে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া পর্যন্ত শান্তিনিকেতন চালিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। সবই চলেছিল তার নিজস্ব তালে, ছন্দে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন আশি বৎসর বয়স পর্যন্ত। এরমধ্যে তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য চর্চা করে গেছেন।
নজরুলের কথা যদি বলি বুলবুলকে হারিয়ে নজরুল পাগলপ্রায়। বুলবুল মারা যাওয়ার নয় বছর পরে নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তারও তিন বছর পরে ১৯৪২ সালে নজরুল নিজে চিরদিনের তরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু বুলবুলের মৃত্যুর পরে (১৯৩০) কবির অসুস্থ হওয়ার সময় পর্যন্ত বারো বছর তাঁর কোনো সাহিত্যকর্ম কি আলোর মুখ দেখেনি? তাহলে সাদি মহম্মদের এমনকি সমস্যা থাকতে পারে, শান্তিনিকেতনে শিক্ষা নেয়ার পরেও নিজেকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিলেন?
সাদি মহম্মদের সমস্যা ছিল। তিনি ডিপ্রেশনে ভুগতেন। এবং সেটা কতদিন যাবত জানা নেই। তাঁর চিকিৎসা কি হয়েছিল সঠিকভাবে? পরিবার সেটার খোঁজ রেখেছিল? পত্রিকায় দেখলাম শিবলী একদিন ফোন করে শামীম আরা নীপাকে বাসায় আসতে বললেন। নীপার কথা সাদি শুনতেন। সেদিন তিনি কথা দিলেন আবার আগের মতো গাইবেন। নীপারা অনুষ্ঠান আয়োজনের কথাও বলেছিলেন। তিনি বারণ করলেন। এর প্রয়োজন নেই। তিনি নিজেই গাইবেন। ব্যস পরিবারের সদস্যরা এতে সন্তুষ্ট হয়ে রইলেন। আর এই উদ্যোগটা সাদি মহম্মদের আত্মহননের বেশিদিন আগে নয়।
সাদি কোন্ অভিমানে বা কার ওপর অভিমান করে চলে গেছেন সেটি কখনোই জানা যাবে না। কেননা জানামতে তিনি কোনো সুইসাইডাল নোট রেখে যাননি। বিভিন্নজন নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করছেন। তবে আমার মনে হয় এখানে কাছের মানুষদের দায়বদ্ধতাই বেশি। সাদির অভিমান থাকতে পারে, প্রত্যাশা থাকতে পারে রাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু যখন সেটা রোগে পরিণত হয় তখন আপনজনদের পাশে দাঁড়াতে হয়। এক্ষেত্রে কেন যেন মনে হচ্ছে বিষয়টি অবহেলিত ছিল।
আজ যদি সাদির স্বাভাবিক মৃত্যু হতো, আমরা সাদির অনুরাগীরা একইরকম কষ্ট পেতাম। যেহেতু সাদি মহম্মদ নিজের জীবনের অবসান নিজের হাতে টানলেন বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে তাই এত কথা হচ্ছে। কিছুদিন পর তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। সাদি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবেন। আবার বছরপূর্তি হলে আমরা তাঁকে স্মরণ করব। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যদিও কিছু প্রশ্নের মীমাংসা কোনদিনই হবে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক