ইসলামাবাদের উপনিবেশের দুরাশা ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2024-03-23 19:54:31

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সংঘটিত অগণিত বিপ্লব প্রচেষ্টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে যখন এক চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে, তখনই চক্রান্ত করে নিশ্চিত স্বাধীনতাকে বহুধাবিভক্ত করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা অনিবার্য পরিণতি আঁচ করতে পেরে চাতুর্যের আশ্রয় নেয়। কাজে লাগায় এই অঞ্চলের ধর্মাশ্রয়ী স্বার্থান্ধ কপট রাজনীতিবিদদের এবং তাদের চক্রান্তের হাতিয়ার হয় ধর্মীয় ভাবাবেগ। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একদিকে এরা যেমন কাজে লাগায়, অন্যদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একাংশকে উগ্র ডানপন্থায় প্রলুব্ধ করে প্রকারান্তরে নব্য ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থানকেই এগিয়ে দেয়।

১৯৪৭ সালে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’র মতো প্রহসনমূলক নীতিকে ভিত্তি করে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় ঔপনিবেশিক মদদে, তা বহু ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির সংকটকেও প্রভাবিত করছে; এনিয়ে সংশয় নেই। খ্যাতিমান সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘অধিকৃত বাংলাদেশে: বাঙালী বিতাড়ন ও নিধননীতির আড়ালে’ শীর্ষক এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিষয়টির স্পষ্ট মূল্যায়ন ফুটে উঠেছে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, কলকাতায় সংবাদপত্র যুগান্তরে।

পাকিস্তানকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দী পরেও সমকালীন রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের যে প্রবণতা বিরাজমান, তাতে আমাদের ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতেই হবে।

‘আসল রাজনৈতিক মতলব’ বর্ণনা করতে গিয়ে চৌধুরী লিখেছেন, ‘‘জিন্নার পর লিয়াকত আলী এবং লিয়াকত আলীর তিরোধানের দীর্ঘদিন পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব করায়ত্ত করেন। যদিও ‘ইসলাম ও মুসলমাদের স্বার্থরক্ষা’ এই শ্লোগানের আড়ালেই এই তিন নেতার রাজনীতি, তথাপি এঁদের একজনও পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানদের কখনো বিশ্বাস করেননি। স্বাধীনতাপূর্ব যুগ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জিন্না-হক বিরোধ, লিয়াকত আলী-সোহরাওয়ার্দী বিরোধ এবং সর্বশেষ পর্যায়ে ভুট্টো-মুজিব বিরোধ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বিচার্য। জিন্না ফজলুল হককে ‘কংগ্রেস ও শ্যামাপ্রসাদের ক্রীড়ানক’ আখ্যা দিয়েছিলেন।’’

তৎকালীন সংবাদপত্রের আশ্রয় নিলে আমরা দেখতে পাবো, ১৯৫১ সালে স্বাধীনতা দিবসে করাচীর জাহাঙ্গীর পার্কের সভায় দাঁড়িয়ে লিয়াকত আলী বলেছিলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুত্তা’। এরপর শেখ মুজিবকে পর্যায়ক্রমে আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টো কর্তৃক ‘ভারতের এজেন্ট ও দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় লক্ষ্য অভিন্ন নয়। ফলে এই দু’অঞ্চলের জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যেও কখনো প্রকৃত সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটি দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলা যাবে। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের কপটতার পরিচয় আমরা পাবো, সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নির্মোহ মূল্যায়নে।

গাফফার চৌধুরীর ভাষায়, ‘জিন্না যেমন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালীদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্পণ করতে চাননি, তেমনি চাননি লিয়াকত আলী, মমতাজ দৌলতানা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভুট্টোও এই একই নীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে মূল সমস্যা এখানেই। জিন্না থেকে শুরু করে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খাঁ সবাই চেয়েছেন, পাকিস্তানে এমন একটি শাসনতন্ত্র তৈরি হোক, যে শাসনতন্ত্রে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপেক্ষিত হবে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা কার্যতঃ তাদের হাতে থাকবে। এই ইচ্ছা থেকেই ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে সংখ্যা সাম্যের অগণতান্ত্রিক বিধান যুক্ত করা হয় এবং হিন্দু ও মুসলমান নাগরিকদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে কার্যতঃ বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমান পরিষদ সদস্যদের জাতীয় পরিষদে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে প্রবল আন্দোলন হওয়ায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।’

হিন্দু নেতাদের ওপর এই চক্রের আরো ক্রুদ্ধ হওয়ার কারণ, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুরা সর্বপ্রকার রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও হিন্দু নেতারা পৃথক নির্বাচনের ফাঁদে পা দিতে রাজি না হয়ে তারা এক বাক্যে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। জিন্নাহ এক্ষেত্রে তাঁর ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব কাজে লাগান। কিন্তু দেশ ভাগের পর হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরকারি নীতির দরুন দ্রুত দেশ ত্যাগ করার পর বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত দেখতে পায়, চাকরি-বাকরি, শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য, সেনাবাহিনী বা বৈদেশিক দপ্তর কোথাও তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটেনি; বরং হিন্দু মধ্যবিত্তের শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে অবাঙালি মুসলমানেরা। ফলে, তাদের রাজনৈতিক অধিকারও খর্ব হয়। অতি দ্রুত তারা বুঝতে পারেন, তাদের আসল ও মূল শত্রু কারা!

উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং মুসলিম লীগ জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়।

১৯৫০ সালে এবং ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে দুটি বড় রকমের দাঙ্গায় তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাঙালিত্ব হরণই সব কিছুর লক্ষ্য। যদিও একটি দাঙ্গাতেও বাঙালি মুসলমানের উদ্যোগ ও উৎসাহ ছিল না। দুটি দাঙ্গাতেই ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা; এটি প্রমাণিত হয় যখন ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় মুসলিম লীগের নেতারা প্রকাশ্যে দাঙ্গার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

গাফফার চৌধুরী তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সালের ঢাকার কোন কোন অবাঙালি মিল মালিক তাদের শ্রমিকদের পুরো দিনের সবেতন ছুটি, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে দাঙ্গায় অংশগ্রহণে প্ররোচনা ও উৎসাহ দিয়েছেন।’

বাংলাদেশে ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্ব কেন ব্যর্থ হয়েছে, তার কার্যকারণও তুলে ধরেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। যদি ১৯৬৯ সালে সেই পরিস্থিতির পর বহু জল গড়িয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির মূলোৎপাটন যে এখনও করা যায়নি, তা তো খোলা চোখেই দৃশ্যমান। এটি কেবল আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, গোটা ভারতবর্ষ, এমন কী আফগানিস্তানসহ বহু দেশেই এই থাবার বিস্তার ঘটেছে।

গাফফার চৌধুরী ১৯৬৯ সালে লিখছেন, ‘হিন্দু নিধন ও বিতাড়ন দ্বারা এই ব্যর্থ ও প্রত্যাখ্যাত তত্ত্বেরই ছিন্নমূল আবার বাংলাদেশের মাটিতে রোপণের অপচেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হলে এবং বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিরোধ চূর্ণ করা গেলে বাংলাদেশে শুধু বাঙালিত্ত্ব বর্জিত মুসলমান বাস করবে এবং যাঁরা হবে ইসলামাবাদের পূর্ণ আনুগত্যশীল, এমন একটা দুরাশা ইয়াহিয়া সরকার এখনও মনে পোষণ করছেন।’

তিনি এও উল্লেখ করেন, ‘বাঙালি মুসলমানের অগ্রসর অংশকে নিপাত করে যদি অবশিষ্ট অংশের বাঙালিত্ব হরণ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ ইসলামাবাদের ষোড়শ শতকী উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হবে, এটা তাদের বিশ্বাস। কয়েক লাখ জাতীয়তাবাদী মুসলমান বাঙালিকে হত্যা, হিন্দু-নিধন ও উৎসাহদানের পর বাংলাদেশে ঊর্দু ভাষা ও পশ্চিম পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া যাবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। এরই মধ্যে কিছু অনুগৃহীত বাঙালির সহায়তায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তথাকথিত ইসলামীকরণের নীতি চালু করা হয়েছে। বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছে, বাংলা ছবি প্রদর্শন বন্ধ হয়েছে, দোকানের সাইনবোর্ড, গাড়ীর নম্বর বাংলায় লেখা বর্জিত হয়েছে এবং শহরাঞ্চলে স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাটের নাম পরিবর্তন শুরু হয়েছে।’

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করা গেছে, এ আমরা সবাই জানি। কিন্তু 'সাম্প্রদায়িকতা'কে রাজনীতির ময়দান থেকে বিতাড়িত করা যায়নি। জাতীয় দিবসসমূহে এনিয়ে আমরা বিস্তর বিলাপ করি বটে, কিন্তু সময়ের বহমানতায় সর্বংসহা জাতি ফের একই ঘূর্ণাবর্তে হাবুডুবু খায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর