যেহেতু ‘প্রতিবাদহীন’, সেহেতু ‘প্রতিকারহীন’

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-03-24 17:23:34

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আজকাল কেউ কথা বলতে চায় না। কথা বলার বিপদ অনেক। ঝুঁকি নিতে চায় না কেউই। ‘যা চলতে চলুক‘, নীতিতে সব অসঙ্গতি ও অন্যায় সহ্য করছে মানুষ। সম্ভবত, প্রতিবাদ না করে মুখ বুঁজে থাকতেই আমজনতা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং নিরাপদ বোধ করছে। কিন্তু এই অসক্রিয়তার ফলাফল হচ্ছে ভীষণ মারাত্মক। যেহেতু  আমরা ‘প্রতিবাদহীন‘ রয়েছি, সেহেতু আমরা ‘প্রতিকারহীন‘ হয়েই থাকছি। সমস্যা ও অসঙ্গতি সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো আমাদের কাঁধে সওয়ার হয়ে আছে। একের পর এক সমস্যায় নাকাল হয়ে আমাদের অবস্থা শোচনীয়। এবং সবচেয়ে রূঢ় সত্য হলো এই যে, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথে না চলায় আমরা কোনো প্রতিকারই পাচ্ছি না। বরং প্রতিনিয়ত সমস্যা ও অসঙ্গতির পাকেচক্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছি। 

প্রতিবাদ ও সমালোচনা না করার কারণে প্রতিকার না পেলেও আমাদের একটি লাভও হচ্ছে। এতে আমাদের সমাজে বসবাসকারী মানুষের সহ্যশক্তি খুবই বেড়ে যাচ্ছে। শরীরের চামড়া বা ত্বকের বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমাদের পাতলা চামড়া হয়ে গেছে গণ্ডারের ছালের মতো মোটা, অসংবেদনী ও স্পর্শকাতরহীন। তাই, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, মানুষ হাসিমুখে সহ্য করতে পারছে দৈনন্দিন জীবনে অসঙ্গতি ও সমস্যা সৃষ্টিকারী কথা ও কার্যক্রম। কেউ কটু কথা বলছে। অশ্লীলতা করছে। দাপট দেখিয়ে সন্ত্রাস করছে। এতে মারছে। ওকে ধরছে। কাউকে তুলে নিয়ে গেছে। ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো হয়েছে। পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছে সিন্ডিকেট। রেপ করছে কোনো অবলা নারী বা তরুণীকে। অপহরণ করছে। মুক্তিপণ নিচ্ছে। পাহাড় কেটে ফেলছে। নদী দখল করে নিচ্ছে। আপনাকে ও আপনার পরিবারকে চতুর্দিক থেকে ভীতি ও আতঙ্কের চাদরে ঢেকে নিচ্ছে। আপনার, আপনার সন্তান, সহনাগরিক ও প্রতিবেশীদের জীবন ও বসবাস বিপন্ন করছে। করুক। কুছ পরোয়া নেহি। আমার কিছু না হলেই হলো।

এহেন মানসিকতার কারণে, একটি বা দুইটি বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হলেও সামাজিক প্রতিরোধ হচ্ছে না। জগন্নাথে একটি ছাত্রীতে জর্জরিত করতে করতে মরতে বাধ্য করা হলে বা জাহাঙ্গীরনগর বা অন্য ক্যাম্পাসের যৌন লোলুপতার পাশবিকতা ছড়িয়ে গেলেও মানুষে ক্ষোভে-প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে না। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস-মতাদর্শ নির্বিশেষে অসঙ্গতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদে এককাতারে শামিল হয়ে মাঠে নেমে আসছে না। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না থাকায়, এইসব জান্তব সামাজিক সমস্যা ও অসঙ্গতিই শক্তিশালী হচ্ছে এবং থাকছে প্রতিকারহীন।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মতোই বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের তরফে শক্তিশালী উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। একটি-দুইটি ব্যতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে এমন কোনো পদক্ষেপ বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের পক্ষেও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, যাতে সমস্যা ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সংবেদনশীলতা তৈরি হয়, মজবুত জনমত গড়ে ওঠে এবং যার পটভূমিতে বড় পরিসরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সঞ্চারিত হয়।

কেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সঞ্চারিত হচ্ছে না, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যে প্রশ্নের সঙ্গে সামাজিক অসঙ্গতির চেয়ে বেশি সম্পর্ক অর্থনীতি ও রাজনীতির। কর্পোরেট আনুগত্য এবং রাজনৈতিক আজ্ঞাবহনের বোঝা টানতে বাধ্য বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া সামাজিক সমস্যা ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো ও প্রতিরোধের ডাক দেওয়া শক্তি বা সাহস, কোনটিই রাখে না। বিদ্যমান বাস্তবতা হলো এটাই।

অথচ সামরিক শাসনের মতোর কঠিন পরিস্থিতিতেও বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া প্রতিবাদমুখর ভূমিকা পালনে দ্বিধান্বিত ছিল না। নিয়মের চাপে নাম প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও পদাতিক, নাগরিক ছদ্মনামে নির্মল সেন, আহমেদ হুমায়ূন সামাজিক অসঙ্গতি ও সমস্যার বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত এনেছেন। র‘নবী ‘টোকাই‘ চরিত্রের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে অন্যায়, অসাম্য ও অব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন। এইসব প্রতিবাদের সূত্রে অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জনমতের সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ প্রতিকার করতে নৈতিক দায় ও বাধ্যবাদকতা অনুভব করেছে। এভাবে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনও হয়েছে অতীতে। অনেক অসঙ্গতির অবসান করাও সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে তেমন হচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না থাকায় সংশ্লিষ্টরা প্রতিকারের চাপ অনুভব করে না। বরং অন্যায়কারীর পাল্লা ভারী হওয়ায় তাদের দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে অধিকাংশ। ফলস্বরূপ, অসঙ্গতি ও সমস্যা বাড়তে বাড়তে কিশোর গ্যাং তাণ্ডব চালাচ্ছে। মাদকচক্রের মৃত্যুকূপ তৈরি হচ্ছে। এমনকি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন ও নেতিবাচক চাপ দিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীকে মানসিকভাবে আহত এবং আত্মহত্যায় বাধ্য করাও সম্ভব হচ্ছে। মোদ্দা কথায়, ব্যক্তি বা সমাজ বা বুদ্ধিজীবী বা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না থাকায় সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকেও প্রতিকারের দৃঢ় পদক্ষেপ নেই।

অথচ অন্যায় ও অসঙ্গতির প্রতিবাদ করা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এটাই মানুষের কর্তব্য। কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাও সম্ভব হচ্ছে না অনেকের পক্ষে। কেন পালন করা সম্ভব হচ্ছে না? কেউ বলবেন ভয়ে। কেউ বলবেন গা বাঁচানোর কারণে। কেউ কেউ রাজনৈতিক কারণকেও হাজির করবেন। আসলে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে, নৈতিক শিক্ষা ও মানসিক শক্তির অভাব। এগুলো না থাকায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথে চলা সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষেই। কারণ, পারিবারিক শিক্ষা তাদের আত্মকেন্দ্রিক, আত্মস্বার্থপর ও আত্মমুখী করেছে। সমাজ ও সমাজের অপরাপর মানুষের সমস্যা ও অসঙ্গতি নিয়ে তাকে ভাবতে ও সক্রিয় হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় নি। 

পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার মতোই ধর্মীয় শিক্ষার অভাবও প্রকট। যে কারণে, ভেজাল, মজুদদারি, মুল্যবৃদ্ধি চলছে লাগামহীনভাবে। এসব অসঙ্গতি নৈতিক দিক দিয়ে তো বটেই, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য। তথাপি দেখা যায় যে, অনেকেই সমস্যা বা অসঙ্গতির নীরব দর্শক হয়। তা নির্মূলে বা প্রতিকারের জন্য কোনো ভূমিকা রাখে না বা রাখার চেষ্টাও করে না। ধর্ম এমন নীরব ভূমিকা সমর্থন করে না। বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যের আলোকে অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা ও তা নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা একজন ধর্মনিষ্ঠ মানুষের প্রতি তার ধর্মের অপরিহার্য দাবি। বিশেষত, একজন মুসলিমের ক্ষেত্রে এটি হলো ‘বিধিবদ্ধ ঈমানি দায়িত্ব‘। কেননা, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)।

তাই, সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রতিটি মানুষের ঈমানি দায়িত্বরূপে স্বীকৃত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,  ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি)

সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল কেবল ব্যক্তি মানুষই নয়, গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়। আর প্রতিবাদহীন হওয়ার অপরাধে, প্রতিকারহীন অবস্থায় থাকতে হয়। অসঙ্গতি ও সমস্যায় হাবুডুব খেয়ে হয় প্রতিনিয়ত। যেমনটি এখন চলছে।  

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)

এ সম্পর্কিত আরও খবর