স্বাধীনতা, অর্থবহ স্বাধীনতা চাই

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-03-26 10:54:45

আমরা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা চাই। ‘স্বাধীনতা নাই’ ভেবে আমরা স্বাধীনতা চাই; স্বাধীনতা প্রাপ্য ভেবে আমরা আওয়াজ তুলি। সেই একাত্তর, সেই উত্তাল দিন; তখন স্বাধীনতা চেয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ। অথচ কেবল একাত্তরেই আমরা স্বাধীনতা চাইনি। এর আগ থেকে স্বাধিকার আন্দোলন, দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে আমাদের স্বাধীনতা-মুক্তির যুদ্ধ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাংলাদেশের। সবটার সঙ্গে জড়িয়ে একটা শব্দ, চূড়ান্ত পরিণতি; স্বাধীনতা!

স্বাধীনতা শব্দের ভার, ব্যাপ্তি আর ইতিহাস অনুসন্ধান ও অনুধাবনের সাধ্য কম অনেকের। কেবল নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়নি; এর পেছনে ছিল দীর্ঘ মুক্তিরসংগ্রাম। দীর্ঘ মুক্তিরসংগ্রামকে তাই আমাদের স্বীকার করতেই হবে। এটা ইতিহাসের দায়; স্বীকার না করলে বাংলাদেশকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হবে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের অর্জন আছে। প্রত্যাশা আছে বলে পাশাপাশি হতাশা আছে। অর্জনকে আমরা অধিকার মনে করি, হতাশাকে মনে করি বঞ্চনা। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা উচ্চকণ্ঠ হই, এটাই স্বাভাবিক। অধিকার-বঞ্চিত আমরা মাঝেমাঝে বলি—“আমরা স্বাধীন নই, আমাদের স্বাধীনতা নাই”। তবে এই ‘স্বাধীনতা নাই’ উচ্চারণের মাঝেই আদতে লুকিয়ে থাকে ‘স্বাধীনতা’। আমাদের স্বাধীনতা আছে বলে উচ্চস্বরে বলতে পারি “আমাদের স্বাধীনতা নাই; স্বাধীনতা চাই”।

স্বাধীনতা চাওয়ার এ দাবি, এ আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরায়ত। চিরায়ত বলেই শাসকের রক্তচক্ষু, প্রাণ হারানোর ভয়কে জয় করেছে অদম্য বাঙালি। তাই মার্চের পঁচিশের বাঙালি-নিধনযজ্ঞ পাকিস্তানিরা পরিচালিত করলেও জাতির মুক্তিদূত শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান গ্রেফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে। শেখ মুজিব জানতেন তিনি আর ফিরতে নাও পারেন, তবু তিনি প্রাণ বাঁচাতে আপস করেননি। তিনি জানতেন তার পরিবারের সদস্যসহ সাত কোটি বাঙালি আছে প্রাণনাশের শঙ্কায়, তবু তিনি মুক্তির উচ্চারণ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙালিকে ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’। পারেওনি।

বাঙালি মরতে শিখেছে—বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ এমনি এমনি আসেনি। দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম তাঁকে এই শিক্ষা দিয়েছে। তিনি জানতেন বাঙালি মৃত্যুঞ্জয়ী। বায়ান্ন থেকে একাত্তরের প্রতিটি পর্যায়ে জাতি তা প্রমাণ করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান এই পথ পরিক্রমায় জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন বলে তুমুল প্রতিকুল অবস্থাতেও দেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেন্ড দূরত্বে তাঁর জীবন, তবু বিচলিত হননি, নেতৃত্বে দেখিয়ে দিয়েছিলেন পথ; আর সেই পথ ধরে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন আর দুই লাখের অধিক নারীর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বিজয়।

‘‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’’ এই ঘোষণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দেশে-বিদেশে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা ইতিহাস-স্বীকৃত। পরবর্তীতে যারা বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণার প্রচার বা পাঠ করেছেন তাদের প্রত্যেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এই ঘোষণা পাঠ করেন। তন্মধ্যে যেমন আছেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান, বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, সুলতানুল আলমসহ অনেকে, তেমনি আছেন জিয়াউর রহমানও। তবে দুঃখজনক বিকৃতি হচ্ছে প্রয়াত মেজর জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে। অথচ জীবদ্দশায় জিয়া নিজেকে কখনও স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। আর বিএনপি যে জিয়াউর রহমানকে ঘোষক বলে দাবি করে সেই জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন ২৭ মার্চ; অথচ সর্বজনস্বীকৃত স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার দিনই।

স্বাধীনতা ঘোষণার দুশো ছেষট্টি দিন পর এসেছে বাঙালির বিজয়। দেশ পেয়েছে একটি পতাকা; পূর্ণাঙ্গ হয়েছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার এই অর্ধশতাব্দীর বেশি দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা প্রায়ই নিজেদের স্বাধীনতা খুঁজি। কেন খুঁজি? এর কিছুটা আছে অর্থবোধক, কিছুটা প্রতীকী, আর কিছুটা বিতর্কের চেষ্টা। কেউ কেউ স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে মরিয়া। পাকিস্তান, নাকি বাংলাদেশ কোনটা শ্রেয়তর—প্রশ্ন তুলতে চায় কেউ কেউ? কারণ অবশ্য অজানা নয়। কী কারণ তবে এর?

একাত্তরের সাত কোটি বাঙালি সকলেই মুক্তিকামী ছিল, এমন না। কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী পাকিস্তানপন্থী ছিল তখন। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা এদেশে চালিয়েছে ভয়াবহ জেনোসাইড। এই জেনোসাইডের সহায়তাকারী শেষ হয়ে যায়নি। সাত কোটি মানুষের দেশটি এখন হয়েছে সতেরো কোটি লোকের। একাত্তরের জেনোসাইডের প্রত্যক্ষ সহযোগী জামায়াতে ইসলামীসহ আরও অনেক দলের রাজনীতি এখনো নিষিদ্ধ নয় বাংলাদেশে। তারা তাই স্রেফ রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এখনো প্রশ্নের মুখে ফেলতে মরিয়া। তারা সংখ্যায় কম নয়। তাই কেবল স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেই ক্ষান্ত হয় না তারা, প্রশ্ন তোলে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে, বীর বীরাঙ্গনাদের নিয়ে, প্রশ্ন তোলে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, প্রশ্ন তোলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে।

যারা প্রশ্ন তোলে তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। তারা 'স্বাধীনতা নাই' বলে অভিযোগ করে, অথচ তাদের এ 'স্বাধীনতা নাই' শব্দবন্ধ উচ্চারণেই থাকে স্বাধীনতা অস্তিত্ব।

আমরা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা চাই। এ চাওয়া চিরায়ত। স্বাধীনতা শব্দের ব্যাপ্তি অনির্দিষ্ট বলে বুঝতে অক্ষম কতখানি চাই, আর কী অবস্থায় আমরা। আদতে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলে কিছু নাই, যা কিছু আছে তা হচ্ছে 'অর্থবহ স্বাধীনতা'; যার নির্ণায়ক হতে পারে কেবল ইতিহাস আর স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করা। স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নাম স্বেচ্ছাচার; আর স্বেচ্ছাচার স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর