অগ্রগণ্য সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 22:49:22

জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে তিনি চিরবিদায় নিলেন। ৭৩ বছর স্পর্শ করা হলো না স্বাধীনতা-পরবর্তী সাংবাদিকতার অন্যতম সিনিয়ার মানুষটির। বুধবার মধ্যরাত পেরিয়ে ক্যালেন্ডারে যখন ১৬ জানুয়ারি, তখন ১৯৪৭ সালের ২৪ জানুয়ারি জামালপুরে জন্মগ্রহণ করা প্রবীণ সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর চলে গেলেন অনন্তের ঠিকানায়।

চিরবিদায় নিলেও ব্রহ্মপুত্রের তীরের এই জাতক প্রায় সাড়ে চার দশক সাংবাদিকতা জগতে গৌরবের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বাংলা দৈনিক আমার দেশ ও ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের (বর্তমানে বিলুপ্ত) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের শুরুর দিকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন একদার নামজাদা ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউনেশনের নির্বাহী সম্পাদক।

মধ্য আশির দশকে এই দাপুটে সাংবাদিককে পেয়েছিলাম ইত্তেফাক ভবনের নিউনেশনে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রূপে কাছ থেকে দেখেছি তাকে। নিউজ রুম ও নিউজ ডেস্ক কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ছিল তার। অপূর্ব দক্ষতায় তিনি সংবাদপত্রের বিভিন্ন সেকশনের মধ্যে টিম স্পিরিট আনতে পারতেন। তিনি এবং ফজলে রশীদ, মোয়াজ্জেম হোসেন, কাজী মন্টু, অরুণাভ সরকার, হাসানুজ্জামান খান প্রমুখের মিলিত উদ্যোগে নিউনেশন তখন দেশসেরা ইংরেজি দৈনিকে পরিণত হয়। বিপুল জনপ্রিয় ইত্তেফাকের মতো একই ভবনের নিউনেশন ছিল লিডিং নিউজ পেপার।

মূলত মৃদ্যুভাষী ও গম্ভীর চরিত্রের মানুষ হলেও আমানুল্লাহ কবীর ছিলেন সহজাত নেতৃত্বগুণে আলোকিত একজন মানুষ।ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব স্থানীয় ছিলেন প্রবীণ এই সাংবাদিক।অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। একটি গ্রুপ ও আদর্শ লালন করলেও তিনি গোত্রীয় ক্ষুদ্রতায় আকীর্ণ ছিলেন না। সর্বজনগৃহীত সাংবাদিক নেতার প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর।

মতাদর্শগত দিক থেকে তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানীর অনুসারী। চীনপন্থি বলে তিনি পরিচত ছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপি ঘেঁষা অবস্থান নিলেও তাকে 'অন্ধ-দলভক্ত' বলা যায় না। দলের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ তিনি করেছেন। দলের অনুগত অতিউৎসাহী, ক্ষমতালিপ্সু, স্বার্থান্ধ সাংবাদিক শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও তিনি কুণ্ঠিত হন নি। শেষ জীবনে তিনি নিজের গ্রুপের উদীয়মান অংশের কাছে ছিলেন কোণঠাসা। তথাপি নিজের স্বাধীন মতামত ও সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

নিউনেশনে বা ঢাকার ভূতের গলির বাসায় তার সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা হয়েছে। জামালপুরে জন্ম নিলেও তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেসব স্মৃতি ও আলাপ তাকে নস্টালজিক করতো। তার এক কন্যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে খুবই ভালো রেজাল্ট নিয়ে। তখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও তিনি দলীয় প্রভাব বিস্তার করে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি দিতে চেষ্টা করেন নি। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেও ক্ষমতার মোহ বা দাপট তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে নি।

আমানুল্লাহ কবীর ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী পেশাদার সাংবাদিকতার একজন অগ্রগণ্য মানুষ। প্রথাগত সাংবাদিকতার কাঠামোর মধ্যে তিনি নিজের পেশাগত উৎকর্ষতা ও বিকাশকে উচ্চতর পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছিলেন। সাংবাদিকতার অগ্রণী মানুষটি এখন সকল কিছুর ঊর্ধে। তার প্রতি শ্রদ্ধা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর