বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি: কী বার্তা দিচ্ছে সশস্ত্র কেএনএফ বাহিনী?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪,কম | 2024-04-03 21:46:05

২৪ ঘণ্টার কম সময়ে বড় আকারের দুটি ব্যাংক লুট অবশ্যই নিরাপত্তাগত বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ঘটনাটিকে ‘ব্যাংক ডাকাতি‘ আখ্যা দেওয়া হলেও তা নিছক চোর-ডাকাতের মামুলী অপরাধকর্ম নয়। এসব আক্রমণের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট জাতিগত অসন্তোষ, পার্বত্য চট্টগ্রামের এলিট নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির ব্যর্থতা এবং মতাদর্শগত প্রণোদনা, যার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এসব সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম করছে। এসব সশস্ত্র পন্থায় তারা ডাকাতিকে উপলক্ষ্য করেছে বটে, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য আরো বড় ও সুদূরপ্রসারী।

শান্তিচুক্তি বিরোধী এই সংগঠনের সাথে যখন সরকারের শান্তির আলোচনা চলমান এবং আগামী ১৬ তারিখ চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে বলে প্রকাশ, তখন এই ধরনের হামলার মাধ্যমে কেএনএফ কী বার্তা দিতে চায়? শান্তি ও চুক্তির প্রতি তারা কী অনাস্থা প্রদর্শন করলো এই ব্যাপাক আকারের অপারেশনের মাধ্যমে? তাছাড়া অতীতে ব্যক্তি বা পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে আক্রমণ করলেও এই প্রথমবারের মতো কেএনএফ প্রশাসন ও সরকারি স্থাপনায় সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়েছে। তারা বিপুল সংখ্যক মানুষকে জিম্মি করেছে। সরকারি অস্ত্র ও ব্যাংকের টাকা লুটপাট করেছে। মসজিদ ও বাজারের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ করেছে। চাইলে বড় আকারের কিছু করাও কেএনএফ-এর পক্ষে সম্ভব ছিল। কারণ, প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তার ব্যবস্থা আদৌ সন্তোষজনক ছিল না।

মঙ্গলবার (০২ এপ্রিল) রাতে রুমায় ব্যাংক লুটের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়ার দাবি করা হলেও তা ছিল কথার কথা। বাস্তবে ঘটনাটির গুরুত্ব ও গভীরতা অনুধাবন করা উপজেলা পর্যাযের জুনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারিদের থাকার কথাও নয়। ফলে পরের দিন (বুধবার, ৩ এপ্রিল) দুপুরের মধ্যেই আরও দুটি ব্যাংকে লুটপাট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে সীমান্ত-সংলগ্ন ও সংঘাত-প্রবণ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোও সামনে চলে এসেছে।

অতীতেও কেএনএফ নাশকতা চালিয়েছে। তাদেরকে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে আস্থায় আসার জন্য দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এতে কিছুদিন স্তিমিত থাকলেও কেএনএফ তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এবার প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধভাবে বড় আকারে আক্রমণ করে কেএনএফ নিজের শক্তির প্রদর্শনী করেছে এবং প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। মসজিদ, বাজার ও পাবলিক প্লেসে আক্রমণ করার সাহস দেখিয়েছে। এমনকি, আক্রমণের একদিন যাওয়ার আগেই এই ধরনের দ্বিতীয় আক্রমন, ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও মানুষকে জিম্মি করার ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা যে প্রস্তুত এবং নিঃশঙ্ক, এই বার্তা সহজেই পাঠ করা যায় কেএনএফ'র অ্যাকশনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এসব আক্রমণ প্রমাণ করে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তাদের বিশ্বাস নেই। থাকলে আলোচনা চলমান সময়ে এবং রমজানের মতো পবিত্র মাসে কেএনএফ আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো না।

তাদের উদ্দেশ্য আরও বড়। সায়ত্ত্বশাসন কিংবা বাংলাদেশের সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ারমান অংশের কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে বড় আকারের ঐক্য গড়া ও বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।

মিয়ানমারে যে জাতিগত সশস্ত্র সংঘাত চলছে, সেখানে কুকি-চিন বা তাদের সমগোত্রী পক্ষগুলো সক্রিয়। এসব পক্ষকে দেশি-বিদেশি শক্তির ইন্ধন দিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করছে। মিয়ানমারে তারা সরকারি সামরিক বাহিনীকে পর্যুদস্তু করছে। ভারতের মণিপুর ও নাগাল্যান্ডকে সংঘাতময় করে তুলছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশের বান্দরবানে অবাধে সশস্ত্র হুমকি দিচ্ছে।

ফলে কেএনএফ কেবল বাংলাদেশ নয়, আন্তদেশীয় পর্যায়ে তৎপর। তাদের দ্বারা অনেক দেশই নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এবং কেএনএফ যত না দেশীয় সংগঠন, বরং একটি আঞ্চলিক সংগঠন। ফলে তাদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদেরকে দমনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

বিশেষ করে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে ভবিষতে আরও বড় আকারের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এবার বান্দরবানে সিরিজ ডাকাতি কালে কেএনএফ নির্বিঘ্নে অপকর্ম করেছে। তাদেরকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি ও শক্তি প্রশাসনের ছিল না, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দেয়।

পার্বত্য রাজনীতি ও নিরাপত্তা কৌশলের ক্ষেত্রেও নীতি নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। গতানুগতিক পন্থায় পাহাড়ের অন্য সংগঠনগুলোর মতো কেএনএফ'কে বাগে আনা সম্ভব কিনা, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। বান্দরবানে একজন সাবেক মন্ত্রী সামরিক-বেসামরিক লোকজনদের নিয়ে যখন রাজকীয় ইতফার পার্টি করেন, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কেএনএফ প্রকাশ্যে বড় আকারে আক্রমণ করলো। ফলে পাহাড়ের ক্ষমতার রাজনীতি এই রেডিক্যাল ফোর্সকে সামাল দিতে পারবে বলে মনে করার কারণ নেই।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরিএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর