কিছুদিন আগেই নির্বাহী আদেশে বাড়লো বিদ্যুতের দাম। অংশীজনদের সঙ্গে শুনানি পর যৌক্তিকতা পর্যালোচনার করে মূল্য বাড়ানোর সুপারিশ প্রদানে ‘এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাকে পাশ কাটিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে জনঅসন্তোষের মাঝেই গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন আরেক খবর জনগণকে আবারও শঙ্কিত করে তুলেছে। খবর অনুযায়ী, রাজধানীর যানজট নিরসনে নাগরিকদের যোগাযোগে নতুন মাত্রা নিয়ে আসা মেট্রোরেলের ভাড়ায় ১৫ শতাংশ করারোপ করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন (১ জুলাই) থেকে ভ্যাট আরোপ হচ্ছে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএল’কে চিঠি দিয়েছে। খবরটি গণমাধ্যমে আসার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগগুলোতে সাধারণের অগণিত প্রতিক্রিয়া এসেছে, বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষ-যারা প্রতিদিন এই মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন। অধিকাংশই এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে যা বলছেন, তার মর্মার্থ মোটামুটি একই রকম, ‘নিরুপায় জনগণের পকেট কাটতে সবাই তৎপর’।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যানজটের শহর ঢাকায় মেট্রোরেল এক নতুন আশার সঞ্চার করে। বিশেষ করে কর্মজীবীদের জন্য এই মেট্রোরেল এক বিরাট আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। যদিও শুরুতেই ঢাকার মেট্রো রেলের ভাড়া বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগে ছিল। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১০০টাকা জনপ্রতি ভাড়া অনেকের জন্য অতিরিক্ত মনে না হলেও যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, তারা একে সাধারণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে বর্ণনা করেন।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পৌছে ৫০ টাকারও কম ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ আছে। সাধারণ যাত্রীরা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, যানজট হ্রাস পাওয়ায় একদিকে বিপুল পরিমাণ জ¦ালানি যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি কর্মঘণ্টাও বেড়ে যাচ্ছে; যার প্রভাব পড়ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে। এমন বাস্তবতায় বছর না গড়াতেই মেট্রোরেলের ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর আরোপের সিদ্ধান্তকে তারা ‘গরীবের পকেট কাটার’ নতুন ফন্দি হিসবে আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মেট্রোরেল কি কোন পণ্য? সেবা প্রদানকারী নতুন একটি যোগগাযোগের মাধ্যমকে কেন মূসকের আওতায় আনা হবে?’
স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে মতামত তুলে ধরা বেশির ভাগই তরুণ, যাদের অনেকেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে চাকুরির আশায় ঘুরছেন কিংবা নতুন কাজে যোগ দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সিস্টেম লস কমিয়ে না এনে, কর্মচারী ও কর্তাব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের লাগাম না টেনে খুব সহজেই মূল্যবৃদ্ধির খড়গ জনগণের ওপর চালিয়ে দিতে খুবই তৎপর।
এনবিআর মেট্রোরেলে করারোপের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছে, ‘রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে। সেজন্য সরকারকে প্রতিনিয়ত অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে, যা মূলত আহরিত হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে। দেশীয় শিল্পের বিকাশ, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি লক্ষ্য সামনে রেখে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। উন্নয়নের বিপুল কর্মযজ্ঞে অর্থের জোগান অব্যাহত রাখাসহ দেশের এলডিসি উত্তরণ এবং কর-জিডিপি অনুপাত কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন খাতের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে প্রদত্ত অব্যাহতি সুবিধা ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে।’-বোঝা গেল সব দায় জনগণইে নিতে হবে।
মেট্রোরেলের ভাড়ায় করারোপের খবর জানার পরদিন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সরকারের সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানালেন, ভ্যাট নির্ধারণের বিষয়টি সরকার অবগত নয়। স্বভাবতোই আমাদের প্রশ্ন জাগে, সরকার তাহলে কে চালায়? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কি তবে সরকারের বাইরের কোন অংশ? সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক যখন এমন কথা বলেন, তখন জনগণের কাছে কি বার্তা যায়? এটি বলে সরকারের মন্ত্রীরা কি তবে জনগণের সঙ্গে উপহাস করেন?
আমরা জানি, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষদের কি অসহায়ত্ব! কাওরান বাজারে মাছের বদলে মাছের কাটা ও উচ্ছিষ্ট কিনে নেওয়ার খবরও সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে! স্বল্প আয়ের মানুষেরা চুলচেরা হিসেব কষেও খরচের হিসেব মেলাতে পারছেন না। প্রিয় সন্তানের আবদার মেটাতে না পেরে অসহায় বাবা-মায়েরা নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। আর্থ-সমাজিক এই সংকটের চিত্র লুকানোর তো সুযোগ নেই।
ক’দিন আগেই আমরা মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছি মহাসমারোহে। এবারের স্বাধীনতা দিবসে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠেই আমরা ধ্বনিত হতে শুনেছি, সমতার যে বাংলাদেশের জন্য একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, সেই স্বদেশের স্বপ্ন আজও অধরাই থেকে গেছে। অর্থনীতিবিদরা এই প্রশ্নও তুলেছেন যে, একটি শ্রেণি যারা তাদের বিপুল অপ্রদর্শিত আয় করে সম্পদ কুক্ষিগত করেছেন, তাদের আর সাধারণ জনগণের কেন একই রকম করের বোঝা টানতে হবে? সম্পদে বৈষম্য থাকলে করারোপেও এই বৈষম্য প্রজোয্য হওয়া উচিত।
অবকাঠামোগত কিংবা নানা সূচকে আমাদের উন্নতি ঈর্ষণীয় হতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকারের যে সুরক্ষা তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি। সেকারণেই সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমভাবে বেড়ে গেছে। এই বৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ সামান্যই চোখে পড়ছে, বরং রক্তশূণ্য শরীরের রক্ত শুষে নিতেই যেন সবাই তৎপর। ঢাকায় মেট্রোরেলের ভাড়ায় করারোপের সিদ্ধান্ত ও সরকারের মন্ত্রীদের এ নিয়ে লুকোচুরি খেলার প্রবণতা সেই বাস্তবতাকেই যেন মেলে ধরছে।