পৃথিবীর শুরুতে শ্রম ছিল একটি গুরুত্বহীন বিষয়। প্রাচীন মিশরীয় যুগে যে দাসপ্রথার উদ্ভব হয়, সেখানে দেখা যায় মানুষকে দাস হিসেবে বন্দী রাখা হতো ও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হত। সেটা পাহাড় কেটে প্রাসাদ বানানো কিংবা পাথরের উপর পাথর বসিয়ে পিরামিড বানানো। ক্ষমতার কাছে শ্রম ছিল কুক্ষিগত। এক হিসেবে ধরা যা্য় পর্যবেক্ষণিক অর্থে “দাস” শব্দটি ছিল শ্রমের আদিশব্দ। সময় ও কালের গতিধারায় মানবজীবন পরিবর্তনশীল ও পরিবর্ধনশীল। সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয় কাজ। আর সেই কাজের জন্য শ্রমের আবিস্কার। গোটা পৃথিবী হয়ে পড়ে শ্রম-নির্ভর। মালিক-শ্রমিক নামক দুটি গোত্রের আবির্ভাব হয় এই শ্রমকে কেন্দ্র করে।
এক দলের কাজের প্রয়োজন, আরেক দলের কাজ করানোর প্রয়োজন। আর সেই থেকে শ্রম বিক্রির ধারণার উদ্ভব হয়। পৃথিবীতে শিল্প-বিপ্লবেরও বহু আগে মানুষের শ্রমের মুল্যায়ন ছিল সস্তা। ইউরোপে কল-কারখানা স্থাপনার পর থেকে ব্যাপকভাবে পুরো সমাজ-ব্যবস্থা হয়ে পড়ে শ্রমিক নির্ভর। কিন্তু শুরুতে আজকের এই আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থার মত এতটা শ্রমিক বান্ধব ছিলনা। বেশি সময় কাজ করানো, মজুরি কম দেওয়া, কর্মঘন্টায় মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ, সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে শাষক ও শোষিত নামক দুটি গোষ্ঠী তৈরী হয়। শ্রমিকের মানেই মানবেতর জীবন। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে উঠে ঔপনিবেশিক তত্ত্ব। দরিদ্র হতে থাকে আরও দরিদ্র। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীতে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। শাষকচক্র তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মেতে উঠে যুদ্ধ-বিগ্রহে। আর তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এই শ্রমিক তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধশ্রম নামে এক নতুন শ্রমের ধারণার উদ্ভব ঘটে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের শাষকশ্রেণী পুরুষদের জোর করে পাঠিয়ে দিত যুদ্ধক্ষেত্রে। এজন্য তাদের মোটা অংকের মজুরি প্রদান করা হত। যুদ্ধের পর গোটা পূর্ব ইউরোপে এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। তা হল পূর্ব ইউরোপ অনেকটা পুরুষ শুন্য হয়ে গেল। যা আঘাত করল পুরো সমাজ ব্যবস্থায়। এক প্রকার নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। নারী, শিশু চলে যেতে থাকল ইউরোপের অন্য অংশ। নারীদের মধ্যে দেখা দিল বহুবিবাহ, বহুগামীতা ও পতিতাবৃত্তি। সমাজ-ব্যবস্থায় ছেয়ে গেল এক অশ্লীলতা ।
উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে শ্রমিক গোষ্ঠির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রম ইতিহাসের বিকাশ ঘটে। পুরো ইউরোপে তখন খন্ড খন্ড শ্রমিক আসন্তোষ, ধর্মঘট ও আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী শ্রম অধিকারের প্রভাব বিস্তার ঘটতে থাকে। আধুনিক যন্ত্রপাতি অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে পশমী বাণিজ্যের সাথে জড়িত শ্রমিকরা ব্রিটেনে লুডিইটস আন্দোলন শুরু করে, যা তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনের আলোচিত ঘটনার একটি বলে ধরা হয়। আমেরিকার হেইমার্কেট দাঙ্গা, হোমস্টেড ধর্মঘট, পুলম্যান স্ট্রাইক ইত্যাদি শ্রম অধিকারের ধারাকে সমুন্নত করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল। যার ফলে আজ আমরা উদযাপন করি মহান মে দিবস।
রুশ বিপ্লবের সময়কালে নাগরিকদের মানবেতর জীবন যাপন ও অভাব অভিযোগ ছিল সাধারণ ঘটনা। ১৯১৭ সালে শ্রমিক অস্থিরতা ও দাঙ্গার মাধ্যমে এই বিপ্লবে শামিল হয় শ্রমিকরা। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে শ্রমিকদের একাত্বতা ঘোষণার মাধ্যমে রুশ বিপ্লবের সফলতা আসে এবং বলশেভিক (কম্যুনিজম) সরকার গঠিত হয়। কালে কালে, যুগে যুগে, পৌত্তলিক থেকে ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক থেকে আধুনিক, সব যুগে সব সময়ে শ্রমিকরা ছিল নিঃগৃহীত, নিস্পেশিত। আর তাই নিজেদের অধিকার আদায়ের ঝান্ডা উঁচিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে কিঞ্চিত। তারা তাদের নির্দিষ্ট্ কর্মঘন্টায় মজুরী পায়। কর্মস্হলে পায় তাৃর প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধা ভোগকারী শ্রমিকরা হল প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। শ্রমিক অসন্তোস, কর্মস্থলে বিয়ভিন্ন ত্রুটির কারণে শ্রমিকের মৃত্যুঝুঁকি, শ্রমবাজারে মন্দাভাব ইত্যাদি বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এক নিত্যকার ঘটনা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের আজ বিদেশ গমণের প্রবণতা এইসব কারণে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সূচক উর্ধ্বমুখী হলেও শ্রমিক বান্ধব দেশ হিসেবে আজও আমরা নিজেদের দাবী করতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। আর তাই আমরা প্রকারান্তরে শ্রমিকদের দাসই ভেবে থাকি। এজন্যই বাড়ীর কাজের লোক, রিকশা-চালক, দারোয়ান এইসব মেহনতি মানুুষগুলোর মহান মে দিবসে কোন ছুটি নেই।তারা জানেও না এই দিবসটি কি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যায্য শ্রম অধিকার।
আগামী পৃথিবীর জন্য রয়েছে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে এক ভয়ংকর বার্তা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ফোর আইআর)। ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, The Fourth Industrial Revolution (4IR)। শারিরীক, ডিজিটাল ও জীবতাত্ত্বিক বলয়ের সংমিশ্রণ।তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি সাধন, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মত বিষয়গুলো এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে এক অসাম্য ও চরম দারিদ্র্যের সূচনা হবে। রোবট ও যন্ত্রপাতি হবে কল-কারখানার শ্রমিক। স্বল্পদক্ষ শ্রমিকরা গণহারে হবে চাকুরীচ্যুত। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা চরম হতাশাব্যঞ্জক হবে। আমরা চাই শ্রমিকের অধিকার, শ্রমিকের স্বাধিকার। শ্রমিকের ঘাম ঝড়ে হয়েছে জংগল থেকে নগর পত্তন। সুউচ্চ অট্রালিকায় রয়েছে শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া। তাবৎ পৃথিবীর উন্নতির অন্তরালে রয়েছে লক্ষ-কোটি শ্রমিকের দেহের ঘাম।
আর তাই মানব সভ্যতা গড়ে উঠার প্রকৃষ্ট হাতিয়ার হল এই দুনিয়ার মজদুর।সবাই বলি, “দুনিয়ার মজদুর এক হও!”
-সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট