শ্রমিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা

, যুক্তিতর্ক

ড. আতিউর রহমান | 2024-05-01 13:35:38

শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে এই আলোচনাটি এমন একটি সময়ে তুলছি যখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি দানা বেধেছে। প্রথমে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং তার ওপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত বাইরের এই সঙ্কটগুলোর কারণে আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সঙ্কটগুলোও নতুন করে প্রকট হয়ে ধরা দেয়ায় সম্ভবত বিগত ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম এতো বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বলা বাহুল্য যে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি ছয় শতাংশের আশেপাশেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে আমাদের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ, আমাদের কৃষি উৎপাদন এবং সর্বোপরি আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো। এই প্রেক্ষাপটে তাই শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে ভাবনা ও আলোচনা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। কারণ আপতকালিন সময়ে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা গেলেই সঙ্কট উত্তরণে আমাদের শ্রমঘন শিল্প খাত থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া সম্ভব। দিনশেষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্পেই। সেই পথেই বাংলাদেশ এখন হাঁটছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো-সহ মেগা প্রকল্পগুলো পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি আরও গতিময় হবে। আর সেই সুবাদে শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধেও বাড়বে।

স্বল্পমেয়াদে এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তো বটেই এমন কি দীর্ঘতর মেয়াদে শ্রমিকবান্ধব অর্থনৈতিক বিকাশের পথ-নকশা তৈরির ক্ষেত্রেও শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এ বিষয়ক দর্শন ও চর্চাগুলো আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা সচরাচর যে সমস্ত দেশকে উন্নত হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের মতো যে সমস্ত স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুত সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশের পথে এগিয়েছে তাদের বাস্তবতার বিশেষ ফারাক রয়েছে। এই পার্থক্যের বিষয়ে সচেতন না থাকলে শ্রমিক কল্যাণের নামে এমন নীতি প্রণিত হতে পারে যাতে করে স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে শিল্পের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে শ্রমিকদেরই।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই এ বিষয়ে নীতি-সংবেদনশীলতা দেখা যায়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ না করে নিজস্ব বাস্তবতার বিষয়ে সচেতন থেকে বাংলাদেশের শ্রমনীতি প্রণিত হওয়ায় আমাদের শিল্প খাতের বিকাশ সহজতর হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪৭ সালের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট’-এ শ্রমিক নিয়োগ বিষয়ে ব্যাপক কড়াকড়ি ছিল। ভারত এই আইনটি নিয়েই স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ দেশে যাত্রা শুরু করে ঐ আইনটি ছাড়াই। ফলে বাংলাদেশের শিল্পোদ্যাক্তারা সহজেই বেশি সংখ্যক সস্তা শ্রমিককে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন। এতে একদিকে কম মূল্যে বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল বেশি বেশি বণ্টন করা সম্ভব হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শ্রম আইনের কড়াকড়ি সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করেননি। কেননা সে সময় সদ্য-স্বাধীন দেশে ঐ অর্থে উদ্যোক্তা শ্রেণীই ছিল না। এমন কড়াকাড়ি আরোপ করলে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশই বন্ধ হয়ে যেতো। তবে স্বাধীন দেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ঠিকই শ্রমিকের কল্যাণ ও স্বার্থের যথাযথ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে: “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা”। ১৫ (খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে: “কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।” ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে: “সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনোভাবে লংঘিত হইলে আইনত; দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।” বঙ্গবন্ধু নিখাদ আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

সংবিধানে শ্রমিক অধিকারের এহেন স্বীকৃতি ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সে সময় দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর অনুপস্থিতির কারণে বড় শিল্পগুলো ছিলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ঐ সব কারখানায় পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নিঃসন্দেহে সংবিধানের নির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার পরিচালকদের চেয়ে বেশি তৎপর হবেন- এমনটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কারখানার প্রতি শ্রমিকদের দায়িত্বশীলতাও বেশি হবে, কেননা তারাও এক অর্থে এই কারখানার মালিক।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই ১৯৭২-এর ১৯ জুলাই আদমজীনগরে শ্রমিক সমাবেশে বলেছিলেন- “ ... ফ্যাক্টরি এখন আর আদমজী নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর বাওয়ানীর নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর দাউদের নাই, ফ্যাক্টরি এখন হয়েছে সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। ... আপনারা প্রোডাকশন বাড়াবেন, আপনারাও খাবেন আর ঐ যে গরীব কৃষক, যাদের টাকায় এই কল-কারখানা গড়ে উঠে। তারাও এ টাকার ভাগ পাবে ...।”

শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে ফিরে যেতে হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের সময়ে। একেবারে যে সময় বঙ্গবন্ধু একজন তরুণ রাজনীতিকি সে সময়টায়। ঐ সময়ে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাগুলো সবেচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর ১৯৫২ সালে চীন সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটিতে। গণমুখী রাষ্ট্রে কৃষক আর শ্রমিকের স্বার্থই যে মূখ্যতম অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিৎ ছিলো তরুণ বঙ্গবন্ধু সে বিষয়ে সদাসচেতন ছিলেন। তাই তরুণ বয়সে গণচীন সফরে গিয়ে নানকিংয়ের কৃষি ফার্মের মতোই আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন সাংহাইতে অবস্থিত বৃহৎ কাপড়ের কলের ব্যবস্থাপনা।

প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা এই কলটি পরিদর্শন করেছিলেন। কমিউনিস্ট দেশেও মিলটি একটি কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা চালাচ্ছিলেন। তার মানে চীনে সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মিলেই মিলটি চালাচ্ছিলেন। মিলগুলো জাতীয়করণ না করেও এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে সকল পক্ষই লাভবান হতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “সরকারকে হিসাব দাখিল করতে হয়। যে টাকা আয় হবে তা শ্রমিকদের বেতন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হবে। আর যা বাঁচবে তা দিয়ে মিলের উন্নতি করতে হবে। আর যারা মালিক তাদের লভ্যাংশের কিছু অংশ দেয়া হয়।” তিনি আরও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এই দেশে যে মেয়ে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু যত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যুবক শ্রমিকরা কয়েকজনে মিলে বাড়িতে বাস করার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সফর শেষে শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি উভয়ে বলেন, “আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আর আমাদের মধ্যে কোনো গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে।” (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা ৭০)।
তরুণ বয়সে বিপ্লবোত্তর চীনে শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করার কৌশলগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভবিষ্যতে নিজে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে শ্রমিক কল্যাণে কি করবেন তার পথ-নকশাই হয়তো সে সময় তিনি দাঁড় করাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তি কালে বৃহৎ শিল্প যখন রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন তখন কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁর নেয়া উদ্যোগগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে এমনটিই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই ১৯৭৩-এ আদমজীনগরের ভাষণে (আগে উল্লিখিত) বক্তৃতায় বলেছিলেন- “প্রত্যেকটা কল-কারখানা আপনাদেরই (শ্রমিকদেরই) করতে হবে। সেভাবেই ম্যানেজমেন্ট বোর্ড হবে।

সরকারের থাকবে, কর্পোরেশনের থাকবে আর শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকবে ... আপনারা শ্রমিকরা ভোট দিয়ে পাশ করে দিবেন, দুইজন আপনার, একজন ব্যাংকের, একজন গভর্নমেন্টের, একজন হলো আপনার জুট কর্পোরেশনের। পাঁচজনে বসে কল-কারখানা চালাবেন। ... আপনাদের কলে যা আয় হবে, তার একটা অংশ আপনাদের শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হবে, আরেক অংশ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। সরকারের কাছে যাবে।” শ্রমিকদের কল্যাণের ভার এভাবেই তিনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের হাতে রেখেছিলেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব। বাংলাদেশের তখনকার বাস্তবতায় এই পদ্ধতিটি সত্যিই সময়োপযোগি ছিল।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতেও এই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করেছিলেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান এবং অংশগ্রহণমূলক করতে সে সময় সকল মহকুমাকে ডিস্ট্রিক্ট-এ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর প্রতিটি থানার সার্বিক তদারকির জন্য একটি করে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবনা ছিল তাঁর। আর সেই কাউন্সিলে আলাদা করে শ্রমিকদের প্রতিনিধি রাখার পরিকল্পনা দিয়েছিলেন তিনি, যাতে করে থানাভিত্তিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াতেও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কমিটিতে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “এক বছরের মধ্যে থানা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে। সেখানে বাকশালের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, কৃষকদের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিকদের থাকবে, যুবকদের থাকবে, মহিলাদের থাকবে।” অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনায় আলাদাভাবে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার এই প্রচেষ্ট থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পরিক্রমায় অংশীজন হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যে একান্ত জরুরি সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশেষ সংবেদনশীল।

নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ ও তাদের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণগুলো বিষয়েও বঙ্গবন্ধু বিশেষ সচেতন ছিলেন। কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তা, কখনো কে কোন জেলা থেকে আগত- ইত্যাদি ইস্যু তুলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ প্রায়শই ব্যাহত হয়েছে পাকিস্তান শাসনামলে। আর শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভেদ বিরাজ করলে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ শক্তি হিসেবে শ্রমিকদের অংশগ্রহণও বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ব বাংলার শ্রমিকরা যেন জাতীয় রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনে কার্যকর শক্তি হিসেবে সামনে আসতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানী অপশাসকরা প্রায়শই এ দেশের শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের বিভেদ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

১৯৫৪-তে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঐক্যজোট যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করার পরপরই তাই আদমজীতে শ্রমিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পায়তারা দেখা গিয়েছিলো। সে সময় বঙ্গবন্ধু কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নির্বাচনে জয় কিংবা মন্ত্রীত্ব পাওয়া উদযাপনের পরিবর্তে শপথ নিয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঐ দাঙ্গা নিরসন করতে। স্বাধীনতা উত্তর কালেও এহেন বিভেদ বৃহত্তর শ্রমিক কল্যাণ ও জাতীয় অগ্রগতির পথে হুমকি তৈরি করতে পারে- এমন আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর ছিলো। তাই বার বার শ্রমিকদের বিভেদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার উদাত্ত আহ্বান তিনি জানিয়েছেন।

আগেই আদমজীনগরে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর দেয়া যে ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উল্লেখ করেছি সেখানেও এ বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- “আদমীজতে রক্ত আমি দেখেছি, ১৯৫৪ সালের রক্ত আমি দেখেছি। মন্ত্রী হয়েছিলাম, শপথ নিয়েছিলাম, মন্ত্রীর দ্বার থেকে সোজা আমি ’৫৪ সালে এই পথে দৌড়াইয়া আদমজীতে আসার চেষ্ট করি। তখন তোমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ... মন্ত্রী হয়ে আদমজীতে এসেছিলাম, সে জন্য মন্ত্রিত্ব ডিসমিস করে সমস্ত মন্ত্রী থেকে বাদ দিয়ে আমাকে জেলে নিয়েছিল। ... যদি আমার শ্রমিক ভাইদের মধ্যে আজকে (স্বাধীন বাংলাদেশে) এই কথা হয়- ওমুক নোয়াখালীরে, ওমক ঢাকার, ওমক কুমিল্লার, ওমক ফরিদপুরের- এর আগে কি আমার মৃত্যু ভালো ছিল না? বলেন আপনারা ওয়াদা করতে হবে যে, আমরা এক, আমরা বাঙালী ...।”

বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আজও শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখা একই রকম জরুরি। এখনও দেশ-বিরোধী চক্র শ্রমিকদের বিপথগামী করে তথাকথিত শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন করতে তৎপর হতে পারে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করতে শ্রমিকরা যে ভূমিকা রাখছেন তার স্বীকৃতি বার বার দিতে হবে। একই সঙ্গে কোন স্বার্থান্বেষী মহল যেন শ্রমিকদের ব্যবহার করে আমাদের অর্জনগুলো ধুলিস্মাত করতে না পারে তার জন্য শ্রমিকদের সচেতন করে তুলতে হবে।

আশার কথা ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারানোর পর বহু ত্যাগের বিনিময়ে হলেও দেশ আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ফিরেছে। এই নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রমিক কল্যাণকে তিনিও একই রকম অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন। চ্যালেঞ্জিং সময়েও তাই জাতীয় মজুরি কমিশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হচ্ছে (সর্বশেষ বেড়েছে গত বছর)।

বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে শ্রমিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন অবশ্য এসেছে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব আরএমজি কারখানাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (২০৯টি) বাংলাদেশি হওয়ায় এক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে তা বলাই যায়। আরও বিপুল সংখ্যক কারখানা এখন সবুজ হওয়ার পথে । বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সবুজ অর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করে এই সবুজ রূপান্তরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শোভন কর্মসংস্থানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে।

আশার কথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সবুজ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে বলেই শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে। রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর আমাদের আরএমজি খাত নিয়ে অনেকেই শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সকল অংশীজনে মিলে কমপ্লায়েন্ট কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়ায় সেই আশঙ্কা সত্য হয়নি। বরং কাজের পরিবেশ উন্নত করার সুবাদে আমাদের সুনাম বেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কারখানার লভ্যাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের পরিকল্পনা সে সময়কার শ্রমিক প্রতিনিধিরা করতে পারছিলেন। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা হাতে গোণা। শিল্প মূলত ব্যক্তি খাত নির্ভর। তবে ব্যক্তি খাতের দেয়া কর থেকে সরকারের যে আয় হয় তার একটি অংশ শ্রমিক পরিবারগুলোর কল্যাণে বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নিশ্চয় ব্যয় করা যায়। ফলে আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতাতেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়িত করা খুবই সম্ভব। শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করতে কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি-কেন্দ্রিক ভাবনাই ভাবতে হবে এমন নয়।

আজও আমাদের দেশের অধিকাংশ শ্রমিকই অদক্ষ। শিল্প খাতের আধুনিকায়ন (অটোমেশন), আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি প্রতিযোগিতা, এবং সর্বোপরি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অদক্ষ শ্রমিকেরা বাড়তি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদেরকে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমেও তাদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এভাবে বঙ্গবন্ধুর শ্রমিক কল্যাণের দর্শনের মূল সুরটি ঠিক রেখে পরিবর্তিত বাস্তবতার উপযোগি করে নতুন করে শ্রমিক কল্যাণের পথ-নকশাই আমাদের দাঁড় করাতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর