সংরক্ষিত নারী আসন, না তামাশা?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-09-01 21:54:29

একাদশ জাতীয় সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি অনুযায়ী এবার আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচিত ২৫৭ জন এমপির জন্য প্রায় ৪৩ জন সংরক্ষিত সদস্য পাবে। সে অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছে মোট ১ হাজার ৫১০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। প্রতিটি ফরম বিক্রি করা হয়েছে ৩০ হাজার টাকায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনেত্রী এবং কণ্ঠ শিল্পীও রয়েছেন।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, এবার সংস্কৃতি জগতের ৬২ জন সংরক্ষিত আসনের ফরম কিনেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন, চিত্রনায়িকা ও সাবেক এমপি কবরী সারোয়ার, সুজাতা, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, অরুণা বিশ্বাস, অপু বিশ্বাস, মৌসুমী, তারিন, ফাল্গুনী হামিদ, অঞ্জনা, নতুন, দিলারা, জ্যোতিকা জ্যোতি, কণ্ঠশিল্পী সুমি আক্তার প্রমুখ। এবারই প্রথম চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতের এত বেশি সংখ্যক নারী আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পাবার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।

রাজনৈতিক সংশ্রবহীন ব্যক্তিদের এমপি হওয়ার এই আগ্রহ মোটেও ইতিবাচক নয়, বিশেষ করে রাজনীতি যেখানে জনকল্যাণের জন্য। কোনও শিল্পী বা অভিনেত্রী যদি জনকল্যাণমূলক কিছু করতে চান, তাহলে তার জায়গা থেকে করার অনেক কিছু আছে, যার নজির সারা পৃথিবীতে আছে। হঠাৎ করে তারা যদি জনপ্রতিনিধি হতে চান, সেটা চান সুযোগ-সুবিধার মোহে, জনকল্যাণের মানসিকতায় নয়। কোনো রকম রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জনপ্রতিনিধি হতে চাওয়া এবং তাদের তা বানানোকে ‘বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

এমনিতেই সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নারীদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না। এরশাদের জাতীয় পার্টির আমলে যখন সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ত্রিশ ছিল তখন এই সংরক্ষিত এমপিদের ঠাট্টা করে ‘ত্রিশ সেট অলঙ্কার’ বলা হতো। অলঙ্কার পরে বসে থাকা বা শোভা-বর্ধন আর হাঁ-ভোট না-ভোট দেয়া ছাড়া সংসদে কোনো কাজ তখনও তাদের ছিল না। এখন সংখাটা পঞ্চাশ হয়েছে, কিন্তু গুণগতভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না।

সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন চালু করা দুটো কারণে। সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রতিযোগিতায় এখনও নারীরা সক্ষমতা অর্জন করেননি, তাই সংসদে নারীদের সুযোগ করে দেওয়া৷

সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীদের স্বার্থ রক্ষায় নারী এমপিরা কথা বলবেন– এমন একটা ভাবনাও ছিল। কিন্তু বাস্তবে গত প্রায় তিন যুগে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিরা সেই প্রত্যাশা পালন করতে পারেননি। এর জন্য অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো বেছে বেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকাওয়ালা, মুখরা, যুদ্ধংদেহী, মেধাশূন্য, শিষ্টাচারজ্ঞানহীন নারীদেরকেই বসায়।

 

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী কিংবা বাবা মারা গেলে স্ত্রী কিংবা মেয়েকে ‘সান্ত্বনা-পুরস্কার’ হিসেবে সংরক্ষিত আসনের এমপি বানানো হয়। এই এমপিরা শাসকদলের গুণগান, বিরোধীদের মুন্ডুপাত, উপস্থিতি বাড়ানো, আসনে বসে ঝিমানো আর বিল পাসের সময় সমর্থন জানানো ছাড়া নারীর পক্ষে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন-এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

 

সংরক্ষিত আসনের এমপিরা নিজ-নিজ দলের সংসদ সদস্যের আনুপাতিক কোটায় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচত হওয়ার কারণে তাদের কোনো নির্বাচনি এলাকা থাকে না। ফলে তাদের দায়-দায়িত্বও নেই। এর আগের সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিত্বের সমতার জন্য আঞ্চলিকভাবে নারী এমপিদের নির্বাচন করেছিলেন। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব এমপিকে এক বা একাধিক জেলার দায়িত্বও দিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। দেশের প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় দলের এমপি ও একই দলের সংরক্ষিত আসনের নারী এমপিদের মধ্যে ঘোরতর বৈরি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এলাকার কোনও কর্মসূচিতে একজন অংশ নেন তো অন্যজন তা বর্জন করেন। দু’পক্ষের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মামলা হামলার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী সংসদ সদস্য এলাকার কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের অসহযোগিতার মুখোমুখি হন।

 

নির্বাচিত এমপিরা জনগণের ভোট পেয়ে ম্যানডেট নিয়ে সংসদে আসেন, জনগণের কাজে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হয়; অনির্বাচিত এমপিরা ভোট পেয়ে ম্যানডেট নিয়ে আসেন না, তাদের সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকাও নেই, নেত্রী ছাড়া কারোর কাছে তাদেরকে জবাবদিহিও করতে হয় না; ফলে নেত্রী ও নেতার স্তুতি গাওয়াই হয়ে পড়ে তখন এই এমপিদের একমাত্র কাজ। এসব এমপিকে কখনও কোনো বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য প্রদান করতে কিংবা রাষ্ট্রপতির ভাষণ কিংবা বাজেটের ওপর দিকনির্দেশনামূলক তথ্যবহুল-তত্ত্বনির্ভর কোনো বক্তব্য দিতেও দেখা যায় না।

 

১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে ১০ বছরের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ভেবেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে অচিরেই নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না। পরবর্তীকালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে প্রথমে ৩০, পরে ৪৫ এবং বর্তমানে ৫০ করা হয়েছে।

 

নারী সমাজের দাবি ছিল সরাসরি ভোটে নির্বাচন করার। রাজনৈতিক দলগুলো সেটি না করে পরোক্ষ ভোট বা ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ চালু রেখেছে। জনগণ নয়, সংসদ সদস্যরা নারী সংসদ সদস্যদের নির্বাচন করবেন। এই ধারা বর্তমান জমানায় একেবারেই তাৎপর্যহীন।

 

সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন কোনো সুফল বয়ে আনার সম্ভাবনা কম। ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মালিকানা সম্ভাব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে সঁপে দিয়ে বসে থাকলে অনন্তকালেও নারীর ক্ষমতায়ন হবে বলে মনে হয় না।

 

এই আসনগুলোর সঙ্গে যদি জনগণের কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে এই আসন রাখার দরকার কি? এই আসনের নির্বাচন সরাসরি হলে শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়, নারী আন্দোলন কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন এবং জনগণের ভোট নিয়ে জাতীয় সংসদে আসতে পারেন।

 

২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিটি পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা পূরণের কোনো লক্ষণ নেই। বরং সার্বিকভাবে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন যে সহিংসতা ও সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, তাতে দল ও নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি সুস্থ ও সহিষ্ণু হলেই নারীরা অধিক সংখ্যায় রাজনীতিতে আসবেন।

অসুস্থ রাজনীতি সেই পথটি প্রায় রুদ্ধ করে দিচ্ছে। নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হলে আগে দলে প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরষতান্ত্রিক মানসিকতা একটা বড় বাধা। আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম-মধ্য, ছোট–বড় সব দলেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকট। আর ডানপন্থীরা তো কখনোই চায় না নারীরা রাজনীতিতে আসুক।

পৃথিবীর সব দেশে রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির ইস্যুটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির অংশ হলেও এযাবৎ রুয়ান্ডা ছাড়া কোনো দেশে এ নীতির বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে বিশ্বগণতন্ত্রায়ণে নারীর প্রবেশ সাম্যতা, মর্যাদা ও প্রভাব কোথাও পুরুষের সমকক্ষ নয় এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই ক্ষমতার প্ল্যাটফর্মে এ সক্ষমতাই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীকে ক্রমবর্ধমান হারে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার, যা কিছুটা হলেও কোটাপদ্ধতির মাধ্যমেই মোকাবিলা করা হচ্ছে।

নারী যেহেতু প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার অর্ধেক, তাই রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির বিষয়টি একই সঙ্গে ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হিসেবে সংযোজনের একমাত্র পন্থা হিসেবে সংসদে নারীর জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে কোটাপদ্ধতির প্রচলন একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হিসেবে গৃহীত। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নারীকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসতে হবে।

'সংরক্ষিত নারী আসন' এখন অনেকটাই তামাশায় পরিণত হয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের জন্য এটি তেমনি বিব্রতকর ও অপমানজনকও বটে। বাংলাদেশের সংসদে এখন ‘সংরক্ষিত নারী আসন' নামক তামাশাটির উপযোগিতা খুব সম্ভবত ফুরিয়ে গেছে। এখন সংসদ ও সংবিধান থেকে 'সংরক্ষিত নারী আসন' প্রথাটি তুলে দিয়ে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নারীদেরকে উৎসাহিত করা উচিত কিনা সেটা ভাবার সময় এসে গেছে।

আর যদি নারীদের জন্য সংরক্ষণ রাখতেই হয়, তবে সেটা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার বিধান সম্বলিত হওয়া উচিত।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর