ব্রেক্সিট ব্যাধি: ব্রিটিশ রাজনীতির উভয় সংকট

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-31 05:03:57

সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যতম  আলোচনার  বিষয় হচ্ছে ব্রেক্সিট। ব্রিটেনের ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পদ্ধতিকেই বলা হচ্ছে ব্রেক্সিট। ১৫ জানুয়ারি ব্রেক্সিট ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে ক্ষমতাসীণ রক্ষণশীল দল কেবল শোচনীয়ভাবে হারেনি, এর নেত্রী হিসেবে খোদ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র রাজনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়েছে। এই পরাজয় যতটা না দলের, তার চেয়ে অনেকে বেশি ব্রেক্সিট প্রশ্নে অনমনীয় সরকার প্রধান থেরেসা মের। কারণ তার দলের ১১৮ জন এমপি ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। ব্রেক্সিট ইস্যুতে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়েও পরদিনই আবার পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে জিতলেন। এর মূল কারণ হলো, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের ১১৮ জন এমপি ব্রেক্সিট প্রশ্নে নিজেদের দলের নেতৃত্ব ও মূলধারার সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ করে বিরোধী শ্রমিক দলের সাথে অভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে তারা আস্থা ভোটের সময় থেরেসা মে’র নেতৃত্বাধীন, তথা নিজেদের দলের সরকারের প্রতি আস্থা ঘোষণা করেছেন।

১৫ জানুয়ারি পার্লামেন্টে খোদ রক্ষণশীলদের বিরাট অংশের বিরোধীতাসহ বিপুল ব্যবধানে ব্রেক্সিটপক্ষ হেরে গেলে বিরোধী দলের নেতা জেরেমি করবিন এ সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন।

ব্রেক্সিটের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইইউ তথা ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে অনেক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃস্টি করবে, এটিই স্বাভাবিক। ব্রেক্সিট ইস্যু ব্রিটেনের ঘরোয়া রাজনীতির অঙ্গনে প্রধান দু’দলের জন্যই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এক দিকে, রক্ষণশীল দলের সরকার এবার কোনো রকম টিকে গেলেও এর আয়ু কত দিন তার গ্যারান্টি নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যারো এসকেইপ অর্থাৎ অল্পের জন্য রক্ষা। মাত্র ঊনিশ ভোটের ব্যবধানের জিতে নিজের সরকারকে টিকাতে পারলেন মে। একদিন আগে তিনি ২৩০ ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন।

১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার আস্থাভোটের মহাবিপদ কাটিয়ে উঠিয়ে সে রাতেই থেরেসা মে সংলাপ শুরু করেন। তখন তিনি একের পর এক বৈঠকে বসলেন বিরোধী দলের নেতাদের সাথে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামীকাল সোমবারের মধ্যে নতুন প্রস্তাব পেশ করা, যাতে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সফল হতে পারেন।

অন্যেদিকে, এই সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ, শ্রমিকদল এখন কী পদক্ষেপ নেবে, সে প্রশ্নে দলের নেতাদের দৃশ্যত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। শ্রমিক দলের নেতা করবিনসহ সিনিয়র নেতারা আবার রেফারেন্ডাম বা গণভোটের পরিবর্তে সরাসরি নতুন নির্বাচন চাচ্ছেন কেন? তার উত্তরে বলা যায়,  তারা আসলে ব্রেক্সিট ইস্যুতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইছেন।

থেরেসা মে’র আশঙ্কা, আবার অনাস্থা ভোটের আয়োজন করা হলে তার দল ঘটনাক্রমে হেরেও যেতে পারে। আর জেরেমি করবিনের আশঙ্কা, আবার গণভোট হলে প্রথম দফার মত যদি ব্রেক্সিটের পক্ষে গণরায় ঘোষিত হয়! তাই বলতে হচ্ছে ব্রেক্সিট ব্যাধি ব্রিটিশ রাজনীতির উভয়পক্ষের জন্য উদ্বেগ ও অস্বস্তির হেতু হয়ে উঠেছে।

বিদ্যমান সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৯ মার্চের মধ্যে বিচ্ছেদ কার্যকর হবে ব্রিটেনের। এর অর্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কয়েক দশকের সম্পর্ক আর থাকছে না তাদের। হাতে আছে মাত্র ৬৮ দিন। ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেই যেখানে নানা অভাবনীয় ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেখানে ব্রেক্সিটের মতো রাষ্ট্রীয় বিচ্ছেদের প্রভাবে ব্রিটেনে তাৎক্ষণিক বিশৃংখলা দেখা দেয়া অসম্ভব নয়। সম্ভাব্য সে সঙ্কট এড়াতে দ্রুত এমন চুক্তিতে পৌঁছুতে হবে ব্রিটেনকে যা একই সাথে মযার্দাকর ও বাস্তবসম্মত।

তবে, ব্রেক্সিট ভোটাভুটিতে আর একটি ভাল বিষয় বেরিয়ে এসেছে যা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা দেখলাম ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা বিশেষ কোনো ইস্যুতে সঠিক মনে করে দলের বা দলীয় প্রধানের  সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও ভোট দিতে পারেন। এটি কি আমরা কল্পনাও করতে পারি?

থেরেসা মে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে ব্রেক্সিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়েছেন। অপরদিকে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের প্রধান প্রতিপক্ষ, শ্রমিক দলের প্রধান হিসেবে জেরেমি করবিন হুশিয়ার করে দিয়েছেন, গ্রহণযোগ্য চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করা চলেব না। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের এই ইস্যুতে নিকট অতীতে রেফারেন্ডামে জয়ী হয়েছে ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসীন রক্ষণশীল দল বা কনজারভেটিভ পার্টি। তারা ইইউ থেকে ব্রিটেনকে সরিয়ে আনার পক্ষে গণরায় পেলেও জাতীয় স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কীভাবে একটি ’সম্মনাজনক চুক্তি’ করা যায় সেটি নিয়ে সরকার চিন্তা করছে।

এবার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এমপিদের অধিকাংশ ব্রেক্সিটের বিরাধিতা করায় থেরেসা মে সরকার কর্তৃক দেশকে ইইউ থেকে প্রত্যাহার করে আনার বিষয়টি বড় একটি হোচট খেয়েছে। আগের সিদ্ধান্ত মাফিক ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার আগে এই জন্য মর্যাদাকর চুক্তির বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে ঐক্যমত পৌঁছাতে হবে। অপর দিকে, তার রক্ষণশীল দলের সরকার এবং এতে নিজের নেতৃত্ব রক্ষা করা থেরেসার জন্য কঠিন বলেই মনে হচ্ছে।

ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পক্ষে ২০২ জন এমপির ভোট পড়েছে তবে বিপক্ষে ছিলেন এর দ্বিগুণেরও বেশি, ৪৩২ জন। সরকার সংসদে আস্থা হারালে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হতো। আগের দিনই জানা গিয়েছিল ব্রেক্সিট ইস্যুতে থেরেসার আসন যতই নড়বড়ে হোক, আস্থা-অনাস্থা ইস্যুতে তার সরকারকে হঠানো সহজ নাও হতে পারে। কারণ থেরেসার দলে ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভাজন থাকলেও দলের সরকার বহাল রাখার পক্ষে তারা সবাই একমত। তদুপরি উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল, ডিইউপি ব্রেক্সিট প্রশ্নে শ্রমিক দলের অনুগামী হলেও তারা কোনোভাবেই শ্রমিক দলীয় সরকার চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় শিগগিরই আরেকটা সাধারণ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফেরার যে আশা করেছিলেন জেরেমি করবিন, তা আপতত পুরণ হচ্ছে না। 

ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক বসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। অষ্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ব্যবসাগুলো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ব্রিটেন যেসব বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ইইউতে নানা সুবিধা পাচিছল, তা হারিয়ে যাবে। অনুরূপভাবে ব্রিটেনে পাওয়া সুবিধা হারাবে ইইউ। ব্রেক্সিট হলে অভিবাসন ইস্যুতে নিজের মতো আইন করতে পারবে যুক্তরাজ্য। এতদিন অভিবাসন বিষয়ে ইইউর যে নীতিমালা ছিল সেগুলো মানতে হতো ব্রিটেনকে। যুক্তরাজ্যে কর্মরত ইউরোপের অন্য দেশের অভিবাসীদের সম্পর্কে বিরুপ মনোভাবের কারণেই অনেকে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ওইসব নাগরিক তাদের কাজ দখল করে নিচ্ছে বলে তাদের অনেকেই অপছন্দ করেন।

ব্রিটেনের সোসাইটি অব মোটর ম্যানুফ্যাকচারর্স অ্যান্ড ট্রেডার্স মনে করে, যথাযথ চুক্তি ছাড়া যদি যুক্তরাজ্য ইইউ ত্যাগ করে, তবে ব্রিটিশ অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, ব্রিটেন যদি নিজেদের অনুকুলে যথাযথ ব্রেক্সিট চুক্তি করতে না পারে তবে ২০১৯ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি কমে যাবে প্রায় ১.৫ শতাংশ যা জার্মানী ও ফ্রান্সের চেয়ে কম হবে। ব্রিটেন এখন যে একক বাজারের সুবিধা ভোগ করছে, ব্রেক্সিট হলে তা আর পারবে না।

আস্থাভোটে থেরেসা মে’র সরকার কোনোরকমে টিকে যাওয়ার পর ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলামিস্ট মন্তব্য করেছেন, ’এখন থেরেসা মে’র সামনে সুযোগ ও শঙ্কা দুটোই অপেক্ষা করছে। শঙ্কা হলো তাকে হয়তো আস্থা ভোটের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। আর সুযোগ হচ্ছে নিজের রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সুরাহা করার প্রচেষ্টা চালানো।’

আমরাও তাই মনে করি। তবে যুক্তরাজ্য এই ব্রেক্সিট নামের রাহু গ্রাস থেকে মুক্ত হতে না পারলে ব্রিটেনের শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক অবস্থাও অনিশ্চিত থেকে যাবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ; বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর